শুক্রবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২১
প্রথম পাতা » ছবি গ্যালারী | ধর্ম | শিরোনাম » ইসলামের ইতিহাসে প্রতিবন্ধী সেবা যেমন ছিল
ইসলামের ইতিহাসে প্রতিবন্ধী সেবা যেমন ছিল
প্রতিবছরের ৩ ডিসেম্বর সারা বিশ্বে প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে পালিত হয়। প্রতিবন্ধী বলতে শারীরিক বা মানসিক এমন কিছু অবস্থা, যার কারণে অন্যদের মতো স্বাভাবিক চলাফেরা, চিন্তাভাবনা ও কাজকর্ম সম্পাদন সম্ভবপর হয় না। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতার জন্য সবাইকে সচেতন করতে দিবসটি উদ্যাপন শুরু হয়।
২০২১ সালের প্রতিপাদ্য হলো, ‘কোভিড-১৯ পরবর্তী অন্তর্ভূক্তিমূলক বিশ্ব গড়তে প্রয়োজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ।’ মূলত প্রতিবন্ধীদের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ও কর্তব্য পালনের ব্যাপারে সচেতন করাই এ দিবসের মূল লক্ষ্য।
একজন সুস্থ মানুষের মতো প্রতিবন্ধীরও বুদ্ধিমত্তা আছে। উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ পেলে তাদের গভীর পাণ্ডিত্বের প্রকাশ ঘটে। বরং অনেক সময় সাধারণ মানুষকে পেছনে ফেলে নিজ কীর্তিগুণে প্রখর মেধাবী প্রতিবন্ধীরা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকে। মূলত বাহ্যিক অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও মেধার ফলে একসময় বিশ্বময় তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিভা ছড়িয়ে পড়ে।
মদিনায় মহানবীর স্থলাভিষিক্ত ছিলেন অন্ধ সাহাবি : প্রখ্যাত সাহাবি আবদুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম (রা.) ছিলেন অনন্য প্রতিভার অধিকারী একজন অন্ধ সাহাবি। বিভিন্ন সময় রাসুল (সা.)-এর অনুপস্থিতিতে সর্বমোট ১৪ বার মদিনায় রাসুল (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কাদেসিয়ার যুদ্ধে তিনি ঝাণ্ডা বহন করেছেন এবং ওই যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। একদা রাসুল (সা.) কুরাইশের নেতৃস্থানীয় লোকদের সঙ্গে ইসলামের কথা বলছিলেন। এমন সময় আবদুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম (রা.) এসে রাসুল (সা.)-কে কিছু বিষয়ে প্রশ্ন করেন। রাসুল (সা.) অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেন। কুরাইশের নেতৃবর্গের সামনে আসা তিনি অপছন্দ করেন। কিন্তু আবদুল্লাহ বিন উম্মে মাকতুম (রা.) দৃষ্টিহীন হওয়ায় তা আঁচ করতে পারেননি।
কিছুক্ষণ পর আল্লাহ তাআলা রাসুল (সা.)-কে তিরস্কার করে আয়াত অবতরণ করেন, ‘সে ভ্রু কুঞ্চিত করেছে এবং মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কারণ তার কাছে অন্ধ লোকটি এসেছে। তুমি কি জানো, সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো। কিংবা উপদেশ গ্রহণ করত, ফলে উপদেশ তারই উপকারে আসত।’ (সুরা : আবাসা, আয়াত : ১-৪) এর পর থেকে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে দেখা হলে তিনি বলতেন, ‘স্বাগত, যার ব্যাপারে আমার রব আমাকে তিরস্কার করেছেন।’ (তাফসিরে কুরতুবি, ১৮৪/১৯)
ইসলামের ইতিহাসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কৃতিত্ব : নিজের দৃঢ় ইচ্ছা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে অনেক জ্ঞানী-গুণী প্রতিবন্ধী হয়েও চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। মুসলিম বাহিনীর পক্ষ থেকে পারস্যে প্রেরিত দূত রিবয়ি বিন আমের (রা.) খোঁড়া ছিলেন। প্রখ্যাত তাবেয়ি মুহাম্মাদ বিন সিরিন (রহ.) বধির ছিলেন। হাদিসশাস্ত্রে অন্যতম গ্রন্থ সুনানে তিরমিজির রচয়িতা ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসা তিরমিজি (রহ.) ছিলেন অন্ধ মুহাদ্দিস। উমাইয়া যুগের প্রখ্যাত কবি কুমাইত বিন জায়েদ আসাদি একজন বধির কবি ছিলেন। আব্বাসি যুগের বাশশার বিন বুরদ একজন অন্ধ কবি ছিলেন। আরবি সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি ও দার্শনিক আবুল আলা মাআররিও অন্ধ ছিলেন।
সর্বপ্রথম দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) সামাজিক নিরাপত্তাবিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করেন। তিনি সর্বপ্রথম শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তথ্যবিবরণীর নথিপত্র চালু করেন। সমাজের অসহায়, প্রতিবন্ধী লোকদের নাম এতে যুক্ত করার ব্যবস্থা করেন। প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত পরিমাণ ভাতার ব্যবস্থা করেন তিনি।
প্রতিবন্ধীর জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা : উমাইয়া খলিফা উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)-এর গৃহীত কার্যক্রম ছিল সর্বজনবিদিত। তখনকার সময়ের প্রখ্যাত ইমাম ইবনে শিহাব জুহরি (রহ.) এক চিঠিতে উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)-কে জাকাতের অংশ থেকে স্থায়ী প্রতিবন্ধী, সাময়িক প্রতিবন্ধী, অসহায় দরিদ্র, বিপন্ন, দেউলিয়াগ্রস্ত ও অর্থ ফুরিয়ে যাওয়া মুসাফিরের জন্য একটি অংশ নির্ধারণ করতে বলেন। এতে মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। সবার জন্য সমান অংশ নির্ধারণ ছিল। প্রত্যেক অন্ধ ও অক্ষম ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে একজন সেবকের ব্যবস্থা থাকত। (মুহাম্মাদ আবু জাহরাহ, আত তাকাফুলুল ইজতিমায়ি ফিল ইসলাম)
ইসলামী শরিয়তে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য শরিয়তের বিধি-বিধান পালনে ছাড় দিয়েছেন। প্রত্যেক ফরজ বিধান তাদের সাধ্যের ওপর নির্ভর করবে। তাই নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও জিহাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো প্রতিবন্ধী তথা অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য পালন করা আবশ্যক নয়।
সুচিকিৎসার ব্যবস্থা : সর্বজনীন চিকিৎসাসেবার জন্য ৮৮ হিজরি ৭০৭ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম উমাইয়া খলিফা ওয়লিদ বিন আবদুল মালিক হাসপাতাল দামেস্কে নির্মাণ করেন। প্রতিবন্ধী ও অক্ষম লোকদের সামাজিক নিরাপত্তার এ ধারা আব্বাসি খলিফাদের সময়ে আরো জোরদার হয়। পরবর্তী সময়ে মামলুক শাসকদের শাসনামলে মিসরে প্রতিবন্ধীদের জন্য চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। সুলতান কালাউনের তত্ত্বাবধানে কায়রোতে ‘বিমারিস্তান’ নামের বিশেষ হাসপাতাল গড়ে ওঠে, যা এখনো চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। সুলতান কালাউন স্বয়ং প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসাসেবার কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
পরকালে আল্লাহর কাছে সওয়াব : সৃষ্টিগত সমস্যার দরুন বিশেষ সেবার মুখাপেক্ষী একজন মুসলিম এই পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করলে সে আল্লাহর কাছে অনেক উঁচু মর্যাদা লাভ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের অগণিত পুণ্য প্রদান করা হবে।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ১০)
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আমি আমার প্রিয় বান্দার প্রিয় দুটি বস্তু তথা দুই চোখ নিয়ে পরীক্ষা করার পর সে এতে ধৈর্য ধারণ করল, এর বিনিময়ে আমি তাকে জান্নাত প্রদান করি।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর ৫৩২৯)
পক্ষান্তরে আল্লাহর কাছে প্রকৃত প্রতিবন্ধী হলো, যারা আল্লাহর সত্য নির্দশন দেখেও আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনেনি। বরং নিজের অন্তর ও চোখ থাকার পরও তার ব্যবহার করেনি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি জাহান্নামের জন্য জিন ও মানুষের অনেককে সৃষ্টি করেছি, তাদের অন্তর আছে, তা দিয়ে তারা অনুধাবন করে না, তাদের চোখ আছে, তা দিয়ে দেখে না, তাদের কান আছে, তা দিয়ে তারা শ্রবণ করে না, তারা তো চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং আরো বেশি পথভ্রষ্ট, আর তারাই উদাসীন।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৭৯)
ইসলামের ইতিহাসে মনীষী ছিলেন যারা : প্রতিবন্ধী হয়েও ইসলামের ইতিহাসে অনেক বহু মনীষী বিরল সম্মান ও মার্যাদা লাভ করেছেন। যেমন—
১. বিশিষ্ট সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাকতুম (রা.)-কে ১৪ বার মদিনার স্থলাভিষিক্ত করেন। অথচ তিনি ছিলেন অন্ধ।
২. বিশিষ্ট সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) পঙ্গু ছিলেন। তাঁকে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে প্রেরণ করেন।
৩. বিশিষ্ট সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) শেষ জীবনে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তারপরও তিনি কোরআনের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার ও সমকালের শ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদের মর্যাদা অর্জন করেন।
৪. বিশিষ্ট তাবেয়ি আতা (রহ.) কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্ধ ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর হাত ছিল পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং পা ছিল ল্যাংড়া।
৫. আসিম ইবনে সুলাইমান আল-বসরি টেরা চোখবিশিষ্ট (মৃত্যু ১৪২ হিজরি) ছিলেন, তিনি হাদিসচর্চায় অনন্য মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
৬. আল-আসাম (সাদা পা-বিশিষ্ট)। হাতিম ইবনে উনওয়ান (মৃত্যু ২৩৭ হিজরি), তিনি আল্লাহভীরুতা, আত্মসংযম ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁকে এ উম্মতের লোকমান হাকিম বলা হতো।
অন্যের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য নয় : মানুষ হিসেবে সবার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকা উচিত। সবার প্রাপ্য অধিকার দেওয়া জরুরি। ইসলামে যেকোনো ধরনের অক্ষম ব্যক্তির প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিপদগ্রস্ত, অসহায়-বিপন্ন বা প্রতিবন্ধীদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কেননা আল্লাহ অনুগ্রহ করে আমাদের সুস্থ-সবল করেছেন। তিনি চাইলে আমাদেরও অক্ষম করতে পারতেন। তাই কাউকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা নিষেধ। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ কোরো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না, ঈমানের পর মন্দ নাম অতি নিকৃষ্ট, আর যারা তওবা করে না তারাই জালিম।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১১)