সোমবার, ৩০ মে ২০২২
প্রথম পাতা » ছবি গ্যালারী | জাতীয় | ঢাকা | শিরোনাম » ত্রুটিপূর্ণ বিমান লিজ, সরকারের গচ্চা ১১০০ কোটি টাকা!
ত্রুটিপূর্ণ বিমান লিজ, সরকারের গচ্চা ১১০০ কোটি টাকা!
২০১৪ সালে পাঁচ বছরের চুক্তিতে ইজিপ্ট এয়ার (মিশর) থেকে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর নামে দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। কিন্তু বছর যেতে না যেতেই ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লাইট পরিচালনার পর একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়।
উড়োজাহাজটি সচল রাখার প্রচেষ্টায় ইজিপ্ট এয়ার থেকে আবারও ভাড়ায় আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। পরে ভাড়ায় আনা ইঞ্জিনও নষ্ট হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সেই ইঞ্জিন মেরামত করতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। এতসব প্রক্রিয়ায় ইজিপ্ট এয়ার ও মেরামতকারী কোম্পানিকে পাঁচ বছরে বাংলাদেশ বিমানের গচ্চা দিতে হয়েছে ১১শ কোটি টাকা। অন্যদিকে দুটি উড়োজাহাজের জন্য প্রতিমাসে বিমান ১১ কোটি টাকা করে ভর্তুকি দিয়ে আসছিল।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসে এসব ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ। যে কারণে অধিকতর তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে গত ২৪ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর সুপারিশ করে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। যার পরিপ্রেক্ষিতে স্থায়ী কমিটির ১ নম্বর সাব-কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন ও স্থায়ী কমিটির সুপারিশ আমলে অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছে।
অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া পরপরই দুদক উপ-পরিচালক সালাহউদ্দিন ও সহকারী পরিচালক জেসমিন আক্তারের সমন্বয়ে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়। অনুসন্ধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করে গত ২৮ মে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নথিপত্র চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল বরাবর পাঠানো চিঠিতে অনুসন্ধান টিম লিজ নেওয়ার দরপত্রসহ অন্তত ১৩ ধরনের নথিপত্র অতি দ্রুত সময়ের জন্য সরবরাহের অনুরোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন। অন্যদিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার দপ্তর থেকে বলা হয়, ‘স্যার জরুরি বৈঠকে রয়েছে। আপনার সঙ্গে পরে যোগাযোগ করা হবে।’
যদিও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের এয়ারক্রাফট বহর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে মিশরীয় ২টি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর এয়ারক্রাফট লিজ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় সংঘটিত অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে একাদশ জাতীয় সংসদের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ১ নং সাব-কমিটি প্রাথমিক তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। দাখিলকরা প্রতিবেদনে গভীরভাবে তদন্ত করার জন্য বিষয়টি দুদকে পাঠানোর সুপারিশ ছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। যতটুকু জানি টিম তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে।
২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর ওই বিমান লিজ গ্রহণের জন্য গঠিত টিম, তাদের আদেশ ও এ সংক্রান্ত নথির ছায়ালিপি, ২০০৯ সালের ১১ জুনে অনুষ্ঠিত ফ্লাইট প্ল্যানিং কমিটির লিজ গ্রহণ সংক্রান্ত সভার সিদ্ধান্তের ছায়ালিপি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের ক্রয় নীতিমালা ও আর্থিক কার্যক্রমের সত্যায়িত ছায়ালিপি, বিমান লিজ গ্রহণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত নথি, টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ও নোটসহ পূর্ণাঙ্গ নথির সত্যায়িত ছায়ালিপি, লিজ নেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দরপত্র ও বিজ্ঞপ্তি কোন কোন পত্রিকায় এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে এ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র, দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটির প্রতিবেদন ও দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিসমূহের তালিকা, লিজ গ্রহণ প্রক্রিয়ায় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন, দরপত্র বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে বিমান ২টি লিজ গ্রহণ এবং ফেরত দেওয়া পর্যন্ত যাবতীয় ব্যয়ের বিল-ভাউচার, রেজিস্ট্রার, ব্যাংক হিসাব বিবরণী, মুড অব ট্রান্সজেকশন সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ছায়ালিপি, বিমান লিজ গ্রহণের উদ্দেশ্যে গঠিত ইন্সপেকশন টিম সদস্যদের নাম, পদবি ও বর্তমান ঠিকানাসহ তালিকা, তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত নথির সত্যায়িত ছায়ালিপি, পাসপোর্টের প্রথম ২ পৃষ্ঠার ফটোকপি এবং মিশরে অবস্থান সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ছায়ালিপি, বিমান দুটির বর্তমান অবস্থা ও অবস্থান সংক্রান্ত তথ্যাদি, বিমানের ৩টা চেক (এ.সি.ডি) সংক্রান্ত নিয়মাবলী বা নির্দেশিকা সংক্রান্ত ছায়ালিপি এবং এয়ারক্রাফট উড্ডয়নের সক্ষমতা, যোগ্যতা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিয়মাবলী বা নির্দেশিকা।
সংসদীয় কমিটির সুপারিশ ও দুদকে আসা অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে পাঁচ বছরের চুক্তিতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজ দুটি লিজ নিয়েছিল বিমান। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লাইট পরিচালনার পর একটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। উড়োজাহাজটি সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকেই ভাড়ায় আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। দেড় বছরের মাথায় নষ্ট হয় বাকি ইঞ্জিনটিও। উড়োজাহাজটি সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে আবারও ভাড়ায় আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। পরে ভাড়ায় আনা ইঞ্জিনও নষ্ট হয়ে যায়। সেই ইঞ্জিন মেরামত করতে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। তবে কোনো সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। সে কারণে ইজিপ্ট এয়ার ও মেরামতকারী কোম্পানি– উভয়কেই অর্থ দিতে হয়েছে বিমানকে। দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজের পেছনে পাঁচ বছরে বাংলাদেশ বিমানের ক্ষতি হয়েছে ১১শ কোটি টাকা। দুটি উড়োজাহাজের জন্য প্রতিমাসে বিমান ১১ কোটি টাকা করে ভর্তুকি দিয়ে আসছিল। সেই দায় থেকে ২০২০ সালের মার্চ মাসে মুক্ত হয় বিমান।
এর আগে গত ২৪ মার্চ সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মিশরীয় উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ দুদকের মাধ্যমে তদন্তের জন্য কার্যবিবরণীর অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে দুটি মিশরীয় এয়ারক্র্যাফট লিজ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগে গঠিত সংসদীয় সাব কমিটির প্রতিবেদন, বিশেষ করে চুক্তিপত্র প্রণয়ন এবং যান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাকরণ টিমের কার্যক্রম ত্রুটিপূর্ণ থাকায় স্থায়ী কমিটির সুপারিশসহ এসব বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুদকে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়।
কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটি সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, কাজী ফিরোজ রশীদ ও তানভীর ইমাম অংশ নেন। এরপরই তা দুদকের পাঠানো হয়েছে বলে জানা যায়।
এর আগে দশম সংসদের বিমান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও দুটি মিশরীয় বিমান লিজ নেওয়া নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। সেসময় লিজে অনিয়মের অভিযোগ তুলে তা তদন্তে কমিটি একটি সাব কমিটিও গঠন করেছিল। চলতি একাদশ সংসদের কমিটিও নতুন করে একটি সাব কমিটি গঠন করে। সাব কমিটি বেশ কিছু অনিয়ম পেয়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করে। পাশাপাশি কমিটি জড়িতদের ডেকে ব্যাখ্যা চায়।
এ বিষয়ে কমিটির অন্যতম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ গণমাধ্যমে বলেন, মিশরীয় এয়ারক্র্যাফট লিজ প্রক্রিয়ার দুর্নীতি সম্পর্কিত সাব কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় যে সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে তা অসমাপ্ত ও পূর্ণাঙ্গ নয়। ব্যারিস্টার তনজীবুল আলমকে প্রথমে আইনের আওতায় আনা উচিত বলে মন্তব্য করেন। এছাড়া তিনি লিজ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থার জন্য দুদকে পাঠানোর সুপারিশ করেন।
কমিটির অপর সদস্য তানভীর ইমাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তদন্তের পর সাব কমিটি যেসব সুপারিশ করেছে, সেগুলোকে মন্ত্রণালয়ের সারসংক্ষেপে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তিনি সুপারিশসমূহ তদন্ত করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দুদকে পাঠানোর প্রস্তাব করেন।