বাংলা সিনেমার সেকাল-একাল
একটা সময় ছিল যখন আধুনিকতার বিন্দুমাত্র ছাপ ছিল না। এপার-ওপার বাংলা তখন একসঙ্গে। হীরালাল সেনের হাতে তৈরি হলো প্রথম বাংলা সিনেমা। পুরো পৃথিবীতেই সিনেমা বলতে প্রথম দিকে বোঝানো হতো বায়োস্কোপকে। উনিশ শতকের একদম শেষ ভাগে বাংলায় প্রথম বায়োস্কোপের দেখা মেলে।
১৮৯৮ সালে প্যারিসের পাথে ফ্রেরেস স্টুডিওর সদস্য অধ্যাপক স্টিভেনসনের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা কলকাতার স্টার থিয়েটারে দেখানো হয়। স্টিভেনসনের ক্যামেরা ধার করে নিয়ে হীরালাল বানান তার প্রথম সিনেমা ‘A Dancing Scene From the Opera’। এভাবেই শুরু বাংলা সিনেমার পথচলা। এরই মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বাংলা সিনেমা বিভক্ত হয়ে যায়। দুই বাংলার সিনেমার মধ্যে তেমনটা দূরত্ব না থাকলেও কিছু পার্থক্য তো থেকেই গেছে।
কলকাতায় বসে বসে চলচ্চিত্রকাররা নির্মাণ করে চলেছেন দারুণসব চলচ্চিত্র, আর ঢাকায় কিছুই হবে না, তা কী আর হয়! তাই বোধহয় ঝটপট কাজে লেগে পড়েছিলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রকাররাও। ১৯২৭-২৮ সালের দিকে ঢাকার নবাব পরিবারের কয়েকজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তারা সুকুমারী নামে চার রিলের একটি নির্বাক চলচ্চিত্র বানান। মজার ব্যপার হলো, সেই সিনেমায় পুরুষরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। নবাব পরিবারের উদ্যোগে ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি গঠিত হয়।
পরবর্তী সময়ে সিনেমাগুলোতে নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন বাইজিরা। অভিনেত্রীরা মূলত ছিলেন বাইজি। অভিজাত পরিবারের নারীরা ধর্মীয় বিধান মেনে অন্দরমহলেই অবস্থান করতেন। চলচ্চিত্র জগতে তাই প্রথম দিকে শুধু বাইজি ধরনের নারীরাই ছিলেন।
সাদা-কালো যুগ
সাদা-কালো যুগে নায়ক-নায়িকাদের প্রেম হতো নদীর ঘাটে, পুকুর পাড়ে কিংবা নায়কের বাঁশির সুরে নায়িকা প্রেমে পড়ত। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। দেখা হতো রাতের বেলা বাঁশবাগানের ধারে, নদীর পাড়ে কিংবা জনমানবহীন কোনো নির্জন জায়গায়। নায়ক-নায়িকার বাবাদের একজন থাকতেন কৃষক আর অন্যজন গাঁয়ের মোড়ল কিংবা জমিদার। এমনই ছিল সে সময়কার বাংলা সিনেমা। টাকা জমিয়ে সেই সিনেমা হলে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখত দর্শক।
রঙিন যুগ
এই যুগে নায়ক-নায়িকাদের প্রেম হয় কলেজে। এ সময়কার সিনেমায় শহুরে গল্পগুলো বেশি প্রাধান্য পেত। সিনেমায় গোলাগুলি, মারধর আর বোমা হামলার দৃশ্য এই যুগে সবচেয়ে বেশি দেখা গেল। ভিলেনকে হত্যার পূর্বমুহূর্তে পুলিশ এসে উপস্থিত হওয়ার দৃশ্য কারোই অজানা নয়।
ডিজিটাল যুগ
এটা বর্তমান যুগের সিনেমার কাল। এখানে নায়ক-নায়িকার পরিচয় হয় ফেসবুক নামক সামাজিক যোগাযোগ সাইটে। এ যুগে নায়ক-নায়িকার দেখা হয় রেস্টুরেন্ট কিংবা দেশ-বিদেশের বিখ্যাতসব জায়গায়। এ যুগের গোলাবারুদ দেখানো হয়েছে আরও উন্নত। উন্নত মানের ক্যামেরার কারসাজিও এখনকার সিনেমায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
স্বর্ণযুগের সিনেমায় গানের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। পরিচালনা, অভিনয়ের পাশাপাশি গান সিনেমাটিকে একটি অন্য মাত্রায় নিয়ে যেত। দিন যত পেরোতে লাগল, বাংলা সিনেমার গান তার জৌলুস হারাতে লাগল। সিনেমায় গান রাখতেই হবে–এ প্রবণতা থেকে বহু অপ্রাসঙ্গিক গানের জন্ম হয়। বর্তমানে বেশির ভাগ সিনেমার গানই সাময়িকভাবে জনপ্রিয় হলেও পরবর্তী সময়ে গানগুলো দর্শকমন থেকে ধীরে ধীরে চিরতরে মুছে যায়।
একসময় বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল চলচ্চিত্র, যাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে হাজারো হল, রমরমা শিল্প৷ সময়ের পরিক্রমায় ঢাকাই সিনেমা পর্দার বাইরের কাহিনিতেই বেশি আলোচিত৷ পরিসংখ্যান বলছে, দিন যত যাচ্ছে বাংলাদেশি দর্শক ততো হলবিমুখ হচ্ছে।