রোজা ফরজ হওয়ার উপযুক্ত সময়
দ্বীন ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। যথা : (১) ঈমান (২) নামাজ, (৩) জাকাত, (৪) রোজা (৫) এবং হজ্জ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, হিজরি দ্বিতীয় সালই ছিল রোজা ফরজ হিসেবে আরোপিত হওয়ার উপযুক্ত সময়। এ পর্যায়ে উল্লেখ্য যে, ইসলামী ইবাদাত যদি দেহ ও প্রাণের সংযোগ হতে খালি হতো এবং এর দ্বারা কেবলমাত্র দৈহিক অনুশীলনই লক্ষ্যণীয় হতো, তাহলে নামাজের পূর্বেই রোজার ফরজিয়ত আরোপিত হতো।
কেননা, জনসাধারণের প্রচলিত মতানুসারে রোজা হচ্ছে উপবাস করার নাম। আরব দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের জন্য এই সৌভাগ্য নসীব হওয়া স্বাভাবিক ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে পরিপূর্ণ ইসলামের আবির্ভাবের পর অবিশ্বাসী কাফিররা মুমিন-মুসলমানদেরকে যে সকল পেরেশানী, দুশ্চিন্তা ও অস্বস্থিকর অবস্থায় নিমগ্ন করে ছিল, যার ফলে তাদেরকে আরব দেশে প্রচলিত সাধারণ রুজি-রোজগারের দিক থেকেও অনিশ্চিত পরিবেশে ফেলে দিয়েছিল। যে সকল লোক বিশ্বনবী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদর্শন করেছিল, সেসব গোত্রের লোকজন তাদের সাথে পারিবারিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।
এমতাবস্থায় রোজা এমন একটি অবশ্য পালনীয় ইবাদাত ছিল, যা আরব দেশের সাধারণ অবস্থা এবং মুসলমানদের চলমান জিন্দেগির জন্য খুবই উপযোগী বলে বিবেচিত হতে পারত। কেননা, নামাজ, জাকাত ও হজ্জের মতো এতে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিরও আশঙ্কা ছিল না। মূলত : রোজা হলো এক প্রকার নিশ্চুপ ইবাদাতের তরীকা, যা কোনো প্রকার বাধা বিপত্তি ছাড়াই জারি রাখা সম্ভব ছিল। কিন্তু ইসলাম ইবাদাতকে রূহানী রোগসমূহের ওষুধ বা প্রতিষেধক হিসেবে সাব্যস্ত করেছে, যার ব্যবহার তখনই করা শোভনীয়, যখন রূহানী রোগসমূহ আত্মপ্রকাশ করে অথবা এগুলো সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
বস্তুত : যৌন ক্ষুধার আকর্ষণ এবং জগতের বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের মনোহারিত্ব, তদসঙ্গে অনুভূতিলব্দ বিষয়াবলির আস্বাদ এবং এগুলোর মাঝে দেহ, মন ও আত্মার নিবেদনের দ্বারা যে সকল রোগ বালাই পয়দা হওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল, মক্কা মুয়াজ্জমায় এ সকল উপায় উপাদানের সহজলভ্যতা মোটেই ছিল না। তাছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে জালিম কাফিরদের জুলুম ও অত্যাচার এসব ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষাকে দৃরিভূত করে দিয়েছিল। এ জন্য সেখানে এই রূহানী চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা বড় একটা প্রকট রূপ ধারণ করেনি। এ জন্যই মহান আল্লাহপাক মুমিন মুসলমানদের ওপর রোজাকে মক্কায় অপরিহার্য করেননি।
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ মুস্তাফা আহমাদ মুজতাবা (সা.) মদীনা মুনাওয়ারায় তাশরীফ আনয়নের পর অবিশ্বাসী কাফিরদের এতসব অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে মুহাজিরগণের পরিত্রাণ মিলে এবং মদীনার আনসারদের আত্মোৎসর্গকারী মনোবৃত্তি মুমিন-মুসলমানদের এবং মোহাজিরদের যাবতীয় দারিদ্র ও দুঃখ-দুর্দশাকে সর্বাংশে লাঘব করে দিয়েছিল।
একই সময়ে দেশ জয়ের সিলসিলাও শুরু হয়। এতেকরে দিন দিন অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ পর্যায়ে এমন একটি সময় এসে গিয়েছিল অথবা নিকটবর্তী হয়ে পড়ে ছিল যে, নানা বর্ণের ও ছন্দের এই দুনিয়া স্বীয় আসল আকৃতিতে মুমিন-মুসলমানদের কাছে আবির্ভূত হয়ে তাদেরকে তাদের অপরিহার্য কর্তব্য পালনে অভ্যস্ত করে তুলেছিল। এ জন্য এই সময়টি ছিল ষোলআনাভাবে ইসলামে অনুপ্রবেশের মৌসুম। যেখানে রোগ উৎপাদনকারী জীবাণুসমূহ থেকে বেঁচে থাকার আবশ্যকতা ছিল প্রবল ও কাক্সিক্ষত।
এই বেঁচে থাকার বা প্রতিরোধ করার ‘ঢাল’ ও বর্মই ছিল সিয়াম সাধনা বা রোজা যা হিজরি দ্বিতীয় সালে ফরয হয়। এতে করে এই সন্দেহ ও দূরিভূত হয়ে যায়, যা কোনো কোনো মুর্খ ও পথভ্রষ্টের মাঝে দেখা দিয়েছিল যে, ইসলামের প্রারম্ভে অভাব-অনটন ও দারিদ্রতার দরুন অধিকাংশ সময় মুসলমানদের উপোস করতে হয়েছিল এবং এভাবেই তাদেরকে রোজা রাখায় অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছিল। মূলত: এই সন্দেহ একান্তই বাতিল ও ভ্রান্ত।
কেননা, ইসলামী বিধান মুতাবেক অভুক্ত অবস্থায় রোজা পালনের যতটুকু প্রয়োজনীয়তা ছিল, ঠিক একইভাবে পেটপুরে আহারকারীদের জন্যও উপবাস পালন করা অধিকতর আবশ্যক ছিল। এতদ প্রসঙ্গে মনীষী আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম (রাহ.) ‘যাদুল মায়াদ’ গ্রন্থে যা বিবৃত করেছেন তা খুবই প্রনিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন : সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধি লাভের প্রাক্কালে দৈহিক ও জৈবিক তাড়নার উপাদানসমূহ বর্জন করা ও আত্মরক্ষা করা খুবই কঠিন কাজ ছিল। এ জন্য রোজাকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরত কালে ফরজ করা হয়েছে, যখন মুমিন মুসলমানগণ তাওহীদ, নামাজ এবং আহকামে কোরআনের অনুসারী হয়ে উঠেছিল। এজন্য সিয়াম সাধনা বা রোজা দ্বীন ইসলামের স্তম্ভের মাঝে অন্তর্ভুক্তির জন্য হিজরি দ্বিতীয় সালটিই ছিল খুবই উপযোগী ও যথাযথ।