ওয়াদা পালনের গুরুত্ব-২
মহানবী (সা.) আমানতদারিকে ঈমানতূল্য উপমা দিয়ে বলেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারি নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই। অনুরূপ ‘যে ব্যক্তি অঙ্গীকার রক্ষা করে না, তার মধ্যে দ্বীন নেই।’ (বায়হাকি, মিশকাত)। তিনি বলেন, ‘মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, যখন দুই পক্ষ মিলে যৌথভাবে কোনো কাজ করে, তখন আমি তাদের (সঙ্গে) তৃতীয় পক্ষ হই। যে পর্যন্ত তারা পরস্পরের সঙ্গে খিয়ানত তথা বিশ্বাসঘাতকতা না করে’ (সুনানে আবু দাউদ)। নবীজি ইরশাদ করেন, ‘যে তোমাকে বিশ্বাস করে, তার বিশ্বাস রক্ষা করো, আর যে তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তুমি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করো না।’ তিনি অন্যত্র বলেন, ‘মুমিনের মধ্যে আর যত দোষই থাক, খিয়ানত তথা বিশ্বাসঘাতকতা ও মিথ্যাচার থাকতে পারে না’ (মুসনাদে আহমদ)।
হজরত ইবনে মাসুদ (রা.) বলেন, ‘আমানতের খিয়ানতকারীকে কিয়ামতের দিন হাজির করা হবে এবং বলা হবে, তোমার আমানত ফেরত দাও। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেমন করে ফেরত দেব? দুনিয়া তো ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন তার কাছে যে জিনিসটি আমানত রাখা হয়েছিল, সে জিনিসটিকে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে হুবহু দেখানো হবে।
অতপর বলা হবে, তুমি সেখানে নেমে পড়ো এবং একে নিয়ে আসো। অতপর সে নেমে যাবে এবং জিনিসটি ঘাড়ে করে নিয়ে আসবে। জিনিসটি তার কাছে দুনিয়ার সব পাহাড়ের চেয়ে ভারী মনে হবে। সে মনে করবে, জিনিসটি নিয়ে আসলে জাহান্নামের আজাব থেকে নিষ্কৃতি পাবে। কিন্তু জাহান্নামের মুখের কাছে আসা মাত্র আবার আমানতের জিনিসসহ জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে পতিত হবে এবং সেখানে চিরকাল থাকবে। ’ মহানবী (সা.) বলেন, মানুষের চারিত্রিক গুণাবলির মধ্য থেকে যে গুণটি সবচেয়ে আগে অদৃশ্য হয়ে যাবে, তা হলো আমানতদারিতা, তথা বিশ্বস্ততা। আর শেষ পর্যন্ত যা রয়ে যাবে, তা হচ্ছে নামাজ।’
বলতে দ্বিধা নেই যে, বর্তমানে সমাজের মাঝে এমন অনেক তথাকথিত হাজী ও নামাজি রয়েছে, যারা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, শয়তানের ওয়াসওয়াসায় আমানতদারি রক্ষা করে না। হাট-বাজারে এমন অনেক ব্যবসায়ীর সন্ধান মেলে, যারা লেবাসে মুত্তাকী হলেও পরহেজগারীতা তাঁদের বাক্সে বন্দি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা খিয়ানত করো না, কেননা খিয়ানত কতই না শাস্তি ও তিরস্কারযোগ্য অপরাধ’ (আবু দাউদ ও তিরমিজি)।
মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমার সাথে চারটি জিনিস থাকলে পৃথিবীর সব হারিয়ে ফেললেও তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। ১. আমানতের সংরক্ষণ; ২. সত্যবাদিতা; ৩. উত্তম চরিত্র ও ৪. পবিত্র রিজিক (আল মুসতাদরাক লিল হাকিম)। বিশ্বনবী হুযুরে মাকবুল (সা.) হলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘আমানতদার, রাহমাতুল্লিল আলামীন। তৎকালীন আরবে, যখন আমানতদারিতার কোনো বালাই ছিল না।
তখন তিনি স্ব গোত্রের কাছে খুব অল্প বয়সেই ‘আল-আমিন’ তথা ‘অতি বিশ্বাসী’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। মাক্কি জীবনে হিজরতের নির্দেশ পাওয়ার পর তাঁর নিকট গচ্ছিত মক্কার কাফির, মুশরিকদের আমানতগুলো তিনি সাবধানতার সাথে এর হকদারদের কাছে নিজ দায়িত্বে পৌঁছে দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.)-এর সাহাবিরাও ছিলেন আমানতদারিতার অনুপম, উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বকে তাঁরা আমানত হিসেবে গ্রহণ করতেন, যা আজ বিশ্ব মুসলিম জাহানসহ গোটা দুনিয়ার সব জায়গায় দুষ্প্রাপ্য।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর কথা। তিনি রাষ্ট্রের বাইতুল মাল তথা অর্থ মন্ত্রণালয়কে আমানতরূপে গণ্য করতেন। হজরত উমর (রা.) অর্ধ জাহানের খলিফা হওয়া সত্ত্বেও মামুলী জীবন যাপন করতেন। খোলাফায়ে রাশেদীনের ৫ম খলীফা হিসাবে খ্যাত হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ. এর খিলাফতকালীন জীবন ইতিহাসের পাতায় আজও স্মরণীয়, অনুকরণীয়।