শনিবার, ২ এপ্রিল ২০২২
প্রথম পাতা » ছবি গ্যালারী | ঢাকা | শিরোনাম » মিল্কী হত্যার প্রতিশোধ নিতেই টিপুকে খুন
মিল্কী হত্যার প্রতিশোধ নিতেই টিপুকে খুন
রাজধানীর শাহজাহানপুরে এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তারদের মধ্যে এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ডও আছেন।
শুক্রবার (১ এপ্রিল) রাতে রাজধানীর মুগদা, শাহজাহানপুর ও মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাব-৩।
গ্রেপ্তাররা হলেন ওমর ফারুক (৫২), আবু সালেহ শিকদার (৩৮), নাছির উদ্দিন (৩৮) ও মোরশেদুল আলম (৫১)। এদের মধ্যে মো.ওমর ফারুক ঘটনার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড।
র্যাব জানায়, ২০১৩ সালে রাজধানীর গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে মিল্কী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। গ্রেপ্তাররা মিল্কীর সহযোগী ছিলেন। এ ঘটনার সঙ্গে টিপু জড়িত ছিলেন বলে গ্রেপ্তাররা সন্দেহ করতেন। তখন মিল্কী হত্যায় যে মামলা দায়ের করা হয়েছিল সেখানে এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন টিপু। কিন্তু বিচারিক কার্যক্রমে তার (টিপু) নাম বাদ পড়ে। যা গ্রেপ্তারদের মনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
র্যাব আরও জানায়, দীর্ঘদিন ধরে ভিকটিম ও হত্যার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বিরোধ ছিল। মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তি বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়েও তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলে আসছিল। আর এসব দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করেই টিপুকে হত্যা করা হয়।
শনিবার (২ এপ্রিল) দুপুরে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, টিপুকে হত্যার জন্য ১৫ লাখ টাকা বাজেট করেন পরিকল্পনাকারীরা। আন্ডার ওয়ার্ল্ড ডন মুসার ওপর দায়িত্ব আসে টিপুকে হত্যার। ঘটনার ১২ দিন আগে মুসা দুবাই চলে যান। সেখানে বসে তিনি কিলার নিয়োগ করা থেকে শুরু করে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
র্যাব জানায়, ঘটনার সাড়ে তিন মাস আগে গ্রেপ্তাররা একটি মামলায় সাক্ষ্য দিতে আদালতে যায়। সেখানে অবস্থান করা কালীন তারা টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী ডন মুসার সঙ্গে পরিকল্পনা করে টিপুকে হত্যা করা হয় কিলার ভাড়া করে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, টিপু ও শিক্ষার্থী প্রীতি হত্যার পর র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। তদন্তের এক পর্যায়ে গতকাল মুগদা, শাহজাহানপুর ও মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে হত্যার সময় নজরদারির কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল এবং হত্যার বাজেটের ১৫ লাখ টার মধ্যে ৩ লাখ টাকা ও মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য সামগ্রী জব্দ করা হয়।
গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে হত্যার মোটিভ সম্পর্কে তিনি বলেন, মিল্কী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতের অভিযোগে টিপুর বিরুদ্ধে মানববন্ধন করে ওমর ফারুক ও তার সহযোগীরা। এছাড়া মিল্কী হত্যা মামলার বাদীর মাধ্যমে টিপুর নাম এজাহারে দেয় ওমর ফারুক এবং তার সহযোগীরা। পরে বিচারিক কার্যক্রমের মামলা থেকে অব্যাহতি পান টিমু।
মামলা থেকে টিপু অব্যাহতি পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হন ওমর ফারুকরা। পরে ২০১৬ সালে একই দ্বন্দ্বের জেরে টিপুর সহযোগী রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবুকে হত্যা করে ওমর ফারুকরা। বর্তমানে রিজভী হাসান হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারকার্য চলছে।
গ্রেফতাররা জানায়, তাদের ধারণা টিপুর কারণেই রিজভী হাসান মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হয়েছে। ইতোমধ্যে মামলার বাদী রিজভী হাসান বাবুর পিতা আবুল কালামের সঙ্গে গ্রেফতার ওমর ফারুক ও তার সহযোগীরা ৫০ লাখ টাকায় দফারফা করার চেষ্টা করে। কিন্তু টিপুর কারণে তা মীমাংসায় আসেনি।
এক পর্যায়ে কালামকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে ওমর ফারুকরা। কিন্তু টিপুর কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরে কালামের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলে তখন তারা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করে। যেন মামলা পরিচালনা ধীরগতি করা যায়। তাদের ধারণা বাদী কালাম একা মামলাটি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আদালত চত্বর থেকেই প্রায় ৩ মাস আগে টিপুকে হত্যার প্রাথমিক আলোচনা করে ওমর ফারুকরা।
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সাক্ষী মো. মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশকে তারা অর্থের বিনিময়ে সাক্ষ্য দিতে বিরত থাকতে বলে। মোরশেদুল আলম রাজী থাকলেও টিপুর চাপে সে সাক্ষ্য দেয়। মোরশেদুল পরবর্তীতে রিজভী হাসান হত্যাকাণ্ডের গ্রেফতার আসামিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে টিপুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়। মোরশেদুল হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে ফারুক ও মুসাকে ফোনে কয়েকজন আন্ডার ওয়ার্ল্ড সন্ত্রাসীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সমন্বয়ের জন্য মুসা গত ১২ মার্চ দুবাই যান। সেখানেই হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত সমন্বয় করা হয়।
হত্যাকাণ্ডটি দেশে সংঘটিত হলেও নিয়ন্ত্রণ করা হয় দুবাই থেকে
ঘটনার আগে দেশ থেকে নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশসহ আরও কয়েকজন টিপুর অবস্থান সম্পর্কে বেশ কয়েকদিন ধরে মুসার কাছে তথ্য দিতেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর মো. নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির আনুমানিক চারবার টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে জানান। পরে টিপুর গ্র্যান্ড সুলতান রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় কাইল্লা পলাশ তাকে নজরদারিতে রাখে। টিপুর অবস্থান সম্পর্কে সে ফ্রিডম মানিক নামে আরেক জনকে জানায়। সেই তথ্য অনুযায়ী কিলার হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়।
তিনি আরও বলেন, জাহিদুল ইসলাম টিপুকে দুবাই বসে হত্যার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দেন সুমন শিকদার ওরফে মুসা। টিপু হত্যাকাণ্ডের ঠিক ১২ দিন আগে দুবাই চলে যান তিনি। দুবাই বসে হত্যার পুরো ছক কষে মুসা। টিপুকে হত্যায় চুক্তি হয় ১৫ লাখ টাকা। এই ১৫ লাখ টাকা কে কত দেবে তাও ভাগ করে দেন মুসা। ৯ লাখ টাকা দেন ওমর ফারুক। অবশিষ্ট ৬ লাখ টাকা দেন গ্রেফতার নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ ও মুসা। দুবাইয়ে যাওয়ার আগে ৫ লাখ টাকা নিয়ে যান মুসা, হুন্ডির মাধ্যমে আরও ৪ লাখ টাকা মুসাকে দেওয়া হয়। বাকি ৬ লাখ টাকা দেশে হস্তান্তর করার চুক্তি হয়। ৬ লাখের মধ্যে র্যাব গ্রেফতারের সময় ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা জব্দ করে।
র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময় কিলার নাছিরকে ঘটনাস্থলের পাশে সাদা শার্ট, জিন্স প্যান্ট ও কেডস পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। ঘটনার পর সে তার মোবাইল ফ্লাশ করে বিক্রি করে দেয় ও সিমকার্ড ভেঙে ফেলে। র্যাব মোবাইলফোন ও সীমকার্ডটি উদ্ধার করেছে। এছাড়া ঘটনার আগেরদিন কিলার নাছির সীমান্তবর্তী চৌদ্দগ্রাম এলাকায় একদিন অবস্থান করেছিলেন।
গত বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে টিপু মাইক্রোবাসে করে শাহজাহানপুর আমতলা হয়ে বাসায় ফিরছিলেন। শাহজাহানপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে পৌঁছালে হেলমেট পরা দুর্বৃত্তরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে টিপু ও তার গাড়িচালক মুন্না গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় টিপুর গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী প্রীতিও গুলিবিদ্ধ হন। তাদের রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জাহিদুল ও প্রীতিকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় পরের দিন শুক্রবার (২৫ মার্চ) দুপুরে নিহত জাহিদুল ইসলাম টিপুর স্ত্রী ফারজানা ইসলাম ডলি বাদী হয়ে শাহজাহানপুর থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১৮।