শনিবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২২
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম | ছবি গ্যালারী | শিক্ষা ও প্রযুক্তি | শিরোনাম » এক শিক্ষকে চলছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
এক শিক্ষকে চলছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে জেগে ওঠা এই দ্বীপটির আয়তন ৮ বর্গমাইল। প্রায় ১১ হাজার মানুষের বসবাস সেন্ট মার্টিন ইউনিয়নটিতে।তবে দ্বীপবেষ্টিত হওয়ায় আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে যেমন পিছিয়ে আছে তেমনি শিক্ষা খাতেও পিছিয়ে আছে এখানকার মানুষ।
পুরো দ্বীপে একটিমাত্র সরকারি প্রাথমিক স্কুল ‘জিনজিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।’ প্রতিষ্ঠানটিতে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২২০ জন।আর শিক্ষক মাত্র একজন।
বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে স্কুলে নিয়োগ পাওয়া চারজন শিক্ষকের মধ্যে উপস্থিত আছেন মাত্র একজন শিক্ষক।একজন নারীঘটিত কেলেঙ্কারির কারণে সাময়িক বরখাস্ত ও বাকি দুজন রয়েছেন ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিইডি) ট্রেনিংয়ে। ফলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা একজন শিক্ষক দিয়েই চলছে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. রিয়াজ উদ্দিন জানান, আমি একজনই শিক্ষক, অসুস্থ হলেও আমাকে স্কুলে আসতে হয়। ছুটি নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, ৭ জন শিক্ষকের কথা থাকলেও নতুন দুই শিক্ষকসহ স্কুলে আছে মাত্র তিনজন শিক্ষক।এর মধ্যে একজন আছেন ডিপিইডি ট্রেনিংয়ে।আর একজন মাত্র গেছেন।তাই আমাকে একাই পুরো স্কুল পরিচালনা করতে হচ্ছে।এর মধ্যে শুধু একজন গেস্ট শিক্ষক আছেন যিনি আমাকে সহযোগিতা করছেন।ফলে শিক্ষকের অভাবে অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে বলে তিনি জানান।
রিয়াজ উদ্দিন বলেন, এখানে সবচেয়ে বেশি সাফার করতে হয় শিক্ষকদের।কারণ, সেন্ট মার্টিনে স্থানীয় শিক্ষক না থাকায় টেকনাফ উপজেলা থেকে এখানে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।তাই টেকনাফ থেকে জাহাজে আসা যাওয়া বাবদ খরচ হয় প্রায় একহাজার টাকার মতো। এমনকি ঘাটের যে নির্ধারিত ভ্যাট শিক্ষক হিসেবে তাতেও কোন ছাড় পাই না আমরা।সেই ভ্যাটও পরিশোধ করতে হয় আমাদের।তাছাড়া এই দ্বীপে সবকিছুর দাম কয়েক গুণ বেশি।
তিনি বলেন, আমার বেতন ১১ হাজার টাকা। অথচ মাসে চারবার আসা যাওয়া ও থাকা খাওয়াসহ আমার প্রতিমাসে খরচ হয় ১০ হাজার টাকা।সরকারিভাবে যাতায়াত ভাড়া যা দেওয়া হয় তা খুবই সামান্য, নামে মাত্র। দ্বীপ এলাকা হওয়ার কারণে এখানে জীবন যাত্রার মান খুবই ব্যয়বহুল। তাই কোনো শিক্ষক পোস্টিং নিয়ে এখানে আসতে চায় না। আবার এলেও বেশি দিন থাকে না বলেও তিনি জানান।
দ্বীপ ভাতা পাচ্ছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দ্বীপ ভাতার কথা বলতে গেলে খুবই দুঃখ হয়, সবচেয়ে প্রত্যন্ত এলাকা হয়েও সেন্টমার্টিনে আমরা দ্বীপ ভাতা থেকে বঞ্চিত।সরকার শিক্ষার উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে, যদি আমাদের জন্য দ্বীপ ভাতার ব্যবস্থা করতেন তাহলে থাকার একটু ঠাঁই হতো।
বিদ্যালয়ের গেস্ট শিক্ষক স্থানীয় বাসিন্দা মো. আব্বাস উদ্দিন জানান, জিনজিরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।কারণ, পর্যটন এলাকা হওয়ায় এখানে দ্রব্যমূল্যের দাম তিনগুণ বেশি।তাছাড়া অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ দ্বীপ হওয়া সত্ত্বেও এখানে শিক্ষকরা দ্বীপ ভাতা পান না।তাই শিক্ষকরা নিয়োগ নিয়ে এখানে আসতে চায় না।
সেন্ট মার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দা জয়নাল মিয়া জানান, শিক্ষকের অভাবে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে যাচ্ছে। তাছাড়া পর্যটন এলাকা হওয়ায় টাকার নেশা তাদেরকে স্কুলবিমুখ করে দিচ্ছে। পর্যটকদের যেকোনো ধরনের সহযোগিতা করলে পাচ্ছে কিছু টাকা, তাই পড়াশোনায় আগ্রহ নেই তেমন একটা।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের চেয়ারম্যান শিক্ষক সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, এখানে একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক স্কুল, যেখানে শিক্ষক সংকট রয়েছে।তাছাড়া দ্বীপের দক্ষিণপাড়ায় কোনো স্কুল নেই।দক্ষিণ পাড়া থেকে জিনজিরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার।বর্ষাকালে ওই এলাকার রাস্তা তলিয়ে গেলে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে আসতে পারে না। তাই এই দ্বীপে আরও দু থেকে তিনটি স্কুলের দাবি জানান তিনি।
শিক্ষক সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে টেকনাফ উপজেলা শিক্ষা অফিসার এমদাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, সাতজন শিক্ষকের পদ থাকলেও স্কুলটিতে কর্মরত আছেন চারজন শিক্ষক। তবে একজন নারীঘটিত কেলেঙ্কারির কারণে সাময়িক বরখাস্ত।আর দুজন আছেন ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন(ডিপিইডি)ট্রেনিংয়ে।পরীক্ষা শেষে একজনের ফেব্রুয়ারিতে স্কুলে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।
দ্বীপ ভাতার বিষয়ে শিক্ষা অফিসার বলেন, সেন্টমার্টিন একটা ছোট ইউনিয়ন হওয়ায় সরকার দ্বীপ ভাতা দিচ্ছেন না। যে উপজেলাগুলো পুরোপুরি দ্বীপ যেমন কুতুবদিয়া সেখানে দ্বীপ ভাতা দেওয়া হয়। কিন্তু মহেশখালী ও টেকনাফের কোথাও দ্বীপ ভাতা দেওয়া হয় না। তবে পর্যটন এলাকা হওয়ায় পর্যটন ভাতা দিতে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে বলে তিনি জানান।
তবে ঘাটের ভ্যাট ও সমুদ্র পথে যাতায়াত ভাড়া কমাতে স্কুল শিক্ষকদের নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করলে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে বলে জানান শিক্ষা অফিসার।