মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর ২০২১
প্রথম পাতা » ছবি গ্যালারী | জাতীয় | শিরোনাম » এক মাল্টিপারপাসে গ্রাহকরা খোয়ালেন শত কোটি টাকা
এক মাল্টিপারপাসে গ্রাহকরা খোয়ালেন শত কোটি টাকা
সমবায় অধিদপ্তরের অনুমোদিত কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড কার্যক্রম প্ররিচালনা করছিল রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী এলাকায়। প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার গ্রাহকের শত কোটির টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার জসিম উদ্দিন।
সোমবার (২৫ অক্টোবর) দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত পল্লবী এলাকায় অভিযান চালিয়ে সমবায় সমিতির নামে প্রতারণার মাধ্যমে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক শাকিল আহম্মেদসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৪।
গ্রেফতার অন্যরা হলেন—মো. চাঁন মিয়া (৩৮), এ কে আজাদ (৩৫), মো. রেজাউল (২২), মো. তাজুল ইসলাম (৩১), মো. শাহাবুদ্দিন খাঁন (২৮), আব্দুস ছাত্তার (৩৭), মো. মাসুম বিল্লা (২৯), মো. টিটু মিয়া (২৮) ও মো. আতিকুর রহমান (২৮)।
মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক।
তিনি বলেন, কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির চেয়ারম্যানের অন্যতম সহযোগী ও প্রকল্প পরিচালক মো. শাকিল আহম্মেদসহ মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে সমবায় সমিতির সভাপতি জসিমসহ সমিতির কার্যকরী কমিটির অন্যান্য সদস্যদের পাওয়া যায়নি। জসিম উদ্দিন ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে অর্থ ট্রান্সফার করে অর্থপাচার করেছেন। নামে বেনামে কিনেছেন প্লট, ফ্ল্যাট ও জমি। ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ গড়ে তুলেছেন আটটি প্রতিষ্ঠান।
মূল অভিযুক্ত জসিম নিজেই সমিতির সভাপতি, সহ-সভাপতি তার শ্বশুর মোতালেব সরকার, সাধারণ সম্পাদক তার প্রথম স্ত্রী লাকী আক্তার, কোষাধক্ষ তার শ্যালিকা শাহেলা নাজনীন, যুগ্ম সম্পাদক নিকট আত্মীয় লাভলী আক্তার। এক রকম পারিবারিক একটি সমিতি। প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধনপ্রাপ্ত। সরকারি হিসাবে প্রতিষ্ঠানটিতে ৫১৮ জন গ্রাহক উল্লেখ করা হলেও গ্রাহকদের অভিযোগ মতে ও র্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার গ্রাহক শত কোটির বেশি টাকা লেনদেন করেছেন প্রতিষ্ঠানটিতে।
প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য অনুযায়ী, কেউ যদি একটি ডিপিএস মাসে এক হাজার টাকা করে বছরে ১২ হাজার টাকা জমা দেয়, তবে পাঁচ বছরে তার ৬০ হাজার টাকা জমা হবে। মেয়াদ শেষে তাকে ৯০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। আর টার্গেট সংগ্রহকারী ব্যক্তি প্রথম এক বছরে প্রতি মাসে দুইশ’ টাকা এবং পরবর্তী ৪ বছর প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে লভ্যাংশ পাবেন। আবার কোম্পানির কোনো সদস্য যদি নতুন কোনো সদস্যকে এক হাজার টাকার এফডিআর করাতে পারেন তাহলে টার্গেট সংগ্রহকারীকে মাসে এক হাজার টাকা এবং এফডিআর করা সদস্যকে মাসে দুই হাজার টাকা দেওয়ার প্রলোভন দিত কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস। প্রকৃতপক্ষে এটা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না।
৫ বছরে ৫০ শতাংশ লভ্যাংশের ফাঁদ
গ্রেফতার শাকিল আহম্মেদ ও চান মিয়া ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্পসময়ে অধিক মুনাফা দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে বিনিয়োগ বা ডিপিএস করতে আগ্রহী করতেন। এভাবে প্রলুব্ধ হয়ে গার্মেন্টসকর্মী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালক, সবজি বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা, গৃহকর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষেরা বিনিয়োগ করতেন। প্রতি সদস্য মাসিক ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা করে কথিত ডিপিএস জমা করতেন। তাদের ৩ বছরে ৩০ শতাংশ এবং ৫ বছরে ৫০ শতাশং মুনাফার প্রলোভন দেওযা হতো। কিন্তু ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের নিয়মিত লভ্যাংশ দেওয়া হতো না। ডিপিএসের মেয়াদ পূর্ণ হলেও পাওনা টাকা পরিশোধ করা হতো না।
ভুক্তভোগীরা লাভের টাকা চাইতে গেলে হুমকি-ধমকি দেওয়া হতো। নারী গ্রাহকদের প্রতি অশালীন মন্তব্য, পুরুষ সদস্যদের টর্চার শেলে নিয়ে মারধর করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযান পরিচালনাকালে শাকিলের অফিসের টর্চার শেল থেকে মারধর করার সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়েছে।
ধূর্ত জসিম সবসময়েই ছিলেন আড়ালে
মূল অভিযুক্ত পলাতক আসামি জসিম উদ্দিন মুন্সিগঞ্জ জেলার বাসিন্দা। ২০০৩ সালে তিনি অল্পসময়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৬ সালে সমবায় অধিদপ্তর থেকে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস নিবন্ধন পায়, ২০১৩ সালে সমিতিটি পুনঃনিবন্ধন পায়।
অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, সমবায় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ সালে তাদের মোট গ্রাহক সংখ্যা ৫১৮ জন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ২০-২৫ হাজার গ্রাহক সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। জসিম কোম্পানিতে নতুন নতুন সদস্য আনয়নের লক্ষ্যে পুরাতন সদস্যদের চাপ দিতেন।
গ্রাহকের টাকায় জসিম গড়েছেন আট প্রতিষ্ঠান
কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. ছাড়াও জসিম নিজের নামে বেনামে আরও সাতটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। জসিম মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কর্ণফুলী রিয়েল এস্টেট লি., জসিম ইন্টান্যাশনাল ওভারসিস লি., জসিম স্টুডেন্ট কনসাল্টেন্সি ফার্ম, জসিম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, জসিম ওয়েলফার ফাউন্ডেশন, জসিম নিট কম্পোজিট লি.। এসব কোম্পানির নামে লেনদেন ও টাকা স্থানান্তর করলেও কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস ছাড়া বাকি সাত কোম্পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
র্যাব-৪ অধিনায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, জসিমের সব আয়ের উৎস হলো কর্ণফুলী মাল্টিপারপাসে ভুক্তভোগীদের ডিপিএস বা এফডিআরের টাকা। অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির জসিম সমিতির অফিসে আসতেন না। সমিতির ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা উত্তোলন করে অন্যত্র স্থানান্তর করতেন। গ্রাহকের টাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট, বাড়ি ও জমি কিনেছেন।
সমবায় অধিদপ্তরের যেসব কর্মকর্তা অডিট করেছিলেন তাদের জিজ্ঞাবাদ করা হবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, ২০১৯-২০২০ সালে সমবায় অধিদপ্তর অডিট করে। অডিটে দেখানো হয় ৫১৮ জন সদস্য। আর লেনদেন দেখানো হয় মাত্র ৮২ লাখ টাকা। অথচ র্যাবের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে লেনদেন হয়েছে, শত কোটির বেশি। বাকি টাকা মানি লন্ডারিং হয়েছে। মামলার প্রেক্ষিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মনে করেন তাহলে সমবায় অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
জসিমসহ তার পারিবারের বাকি সদস্যদের গ্রেফতার সম্পর্কে মোজাম্মেল হক বলেন, র্যাবের তথ্য মতে জসিম দেশেই আছে। তাকেসহ পারিবারিক চক্রটির সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।