মঙ্গলবার, ২৪ মে ২০২২
প্রথম পাতা » আন্তর্জাতিক | ছবি গ্যালারী | শিরোনাম » বিশ্বজুড়ে ভোজ্যতেল নিয়ে এত হাহাকার কেন
বিশ্বজুড়ে ভোজ্যতেল নিয়ে এত হাহাকার কেন
বিশ্বজুড়ে ভোজ্যতেল নিয়ে চলছে চরম হাহাকার। করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, বিরূপ আবহাওয়া, শ্রমিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, তেলের অবৈধ মজুত, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা প্রভৃতি কারণে বিশ্বে ভোজ্যতেলের ঘাটতি ও এর দাম রেকর্ড পর্যায়ে গেছে।
বিশ্বে ভোজ্যতেল শুধু রান্নার কাজেই ব্যবহার করা হয় না, বিস্কুট, মাখন, লন্ড্রি ডিটারজেন্ট, চকলেট উৎপাদনসহ নানা কাজে ব্যবহার হয়।
বিশ্বের শীর্ষ চারটি জনপ্রিয় ভোজ্য তেল হলো পাম, সয়াবিন, সরিষা, সূর্যমুখী। বিশ্ব বাজারে বিদ্যমান তেলের সংকট কি আসলেই যৌক্তিক; কতদিন থাকবে এই সংকট? বিশ্বব্যাপী প্রধান ভোজ্যতেলের উৎপাদক, রফতানিকারক ও আমদানিকারকদের নিয়ে এই প্রতিবেদন-
পাম তেল
পাম তেল এখন পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত, ব্যবহৃত ও ব্যবসাসফল তেল। বিশ্বে শীর্ষ ভোজ্যতেলের প্রায় ৪০ শতাংশ চাহিদা মেটায় এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) তথ্যমতে, ২০২২ সালে ৭ কোটি ৭০০ লাখ টন পাম তেল উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাম তেলের শীর্ষ উৎপাদক, রফতানিকারক ও ভোক্তা হলো এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া। দেশটি বিশ্বে পাম তেলের প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দেয়। এরপর তেল সরবরাহে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মালয়েশিয়া। দেশটি বিশ্বব্যাপী ২৫ শতাংশ পাম তেল সরবরাহ করে থাকে।
অন্যদিকে পাম তেল আমদানিতে শীর্ষ দেশ ভারত। এরপর এর প্রধান ক্রেতা- চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিসর ও কেনিয়া।
ইউএসডিএর তথ্যানুসারে, ভারত বছরে ৪০ শতাংশ ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটায় পাম তেল থেকে। ইন্দোনেশিয়ার বাণিজ্যনীতি, ভোজ্যতেলের উচ্চ দাম ও অন্যান্য কারণে ভারতে এ বছর পাম তেল আমদানি কমেছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে অভিবাসী শ্রমিক কমে যাওয়ায় পামগাছ পরিচর্যা ও এর ফল সংগ্রহে বিঘ্ন ঘটে। এর ফলে ২০২০ ও ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী পাম তেলের উৎপাদন কমে। এ কারণে ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ২৮ এপ্রিলে ভোজ্যতেল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ইন্দোনেশিয়া জানায়, ইউক্রেনের যুদ্ধ আর কোভিড মহামারির কারণেও তাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
সয়াবিন তেল
বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বাধিক উৎপাদিত ভোজ্য তেল হলো সয়াবিন। ২০২২ সালে প্রায় ৬ কোটি টন সয়াবিন তেল উৎপাদন করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সয়াবিন উৎপাদনে প্রথম স্থানে রয়েছে চীন। দেশটি বছরে দেড় কোটির বেশি টন সয়াবিন তেল উৎপাদন করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র (১ কোটি ২ লাখ টন) ব্রাজিল (প্রায় ১ কোটি টন) ও আর্জেন্টিনা প্রায় ৮০ লাখ টন তেল উৎপাদন করে।
ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রফতানি নিষিদ্ধ করায় সয়াবিন তেলের মূল্যও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে।
সয়াবিন তেলের শীর্ষ রফতানিকারক দেশ আর্জেন্টিনা। কিন্তু সয়াবিন উৎপাদনের মৌসুম ভালো না হওয়ায় এ বছর কম তেল রফতানি করছে দেশটি। অভ্যন্তরীণ খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য আর্জেন্টিনা মার্চের মাঝামাঝি সয়া তেল রফতানি বন্ধ করে দেয়।
আর্জেন্টিনার পরে সয়া তেল বৃহৎ আকারে রফতানি করে ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্র। ভোজ্যতেল ব্যবহারের প্রবল চাহিদার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগামী বছরগুলোয় আরও সয়া প্ল্যান্ট চালুর আশা করছে।
সয়াবিন তেল আমদানিতেও শীর্ষ দেশ ভারত।
সরিষার তেল
ইউএসডিএর তথ্যানুযায়ী, এ বছর বিশ্বে প্রায় ৩ কোটি টন সরিষার তেল উৎপাদন হতে পারে। সরিষার তেল উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে ইউরোপ, কানাডা ও চীন। আর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রই এ তেলের প্রধান আমদানিকারক।
২০২১ সালে কানাডায় খরার কারণে সরিষার উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইউরোপেও এই শস্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। এর ফলে ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে সরিষার তেলের সরবরাহ কমেছে।
কানাডার অয়েলসিড প্রসোসেরস অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ২০২১ সালে কানাডা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছে ৭৫ শতাংশ সরিষার তেল রফতানি করেছে।
শীর্ষ ভোজ্যতেল আমদানিকারক ভারত এ বছর রেকর্ড পরিমাণ সরিষা চাষ করেছে। দেশটিতে এই তেল মাস্টার্ড অয়েল নামেও পরিচিত।
সূর্যমুখী তেল
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার মতে, ইউক্রেন ও রাশিয়া বিশ্বে চাহিদার ৫৫ শতাংশ সূর্যমুখী তেল উৎপাদন ও ৫৩ শতাংশ রফতানি করে। কিন্তু রাশিয়ার সামরিক অভিযানের কারণে ইউক্রেনের তেল রফতানি ও উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়।
ঐতিহ্যগতভাবে চীন, ভারত ও ইউরোপ সূর্যমুখী তেলের প্রধান আমদানিকারক। কিন্তু তারা এখন কৃষ্ণ সাগরীয় দেশ থেকে সরে গিয়ে বিকল্প উৎস থেকে তেল খোঁজা শুরু করেছে।
ভারত সাধারণত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে ৯০ শতাংশের বেশি সূর্যমুখী তেল আমদানি করে। ইউএসডিএর তথ্যমতে, আর্জেন্টিনা সূর্যমুখী তেল উৎপাদনে পঞ্চম স্থানে রয়েছে।
বিশ্ববাজারে এখন কেমন অবস্থা
বিশ্ববাজারে এক বছর ধরেই তেলসহ নিত্যপণ্যের অনেক কিছুর দাম বেশি ছিল। বিশেষ করে করোনার কারণে ২০২০ সালের শেষ দিকে এসে সারা বিশ্বেই এই প্রবণতা দেখা যায়। এই পরিস্থিতির আরও অবনতি হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর। এই দুটি দেশ থেকে তেল সরবরাহে ঘাটতি হওয়ায় ব্যাপক চাহিদা বাড়ে পাম ও সয়াবিন তেলের। আবার পাম তেলের প্রধান সরবরাহকারী ইন্দোনেশিয়াও বিশ্ববাজারে তেল ছাড়া বন্ধ করে দেয়। ফলে এপ্রিলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ২২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে এবং প্রতি মেট্রিক টন তেলের দাম রেকর্ড পর্যন্ত উঠে। এপ্রিলের শেষ দিকে তেলের দাম ছিল ১৯১৯ ডলার।
বিপাকে আমদানিনির্ভর দেশগুলো
ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো আমদানিকারক দেশগুলো মালয়েশিয়া থেকে পাম তেল আমদানি করতে পারে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার রফতানি নিষেধাজ্ঞার ফলে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা পূরণ করা কঠিন। শুধু ভারত নয়, ইন্দোনেশিয়া থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ৮০ শতাংশ তেল আমদানি করে। ইন্দোনেশিয়ার তেলের চাহিদা অন্য কোনো দেশের পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়। পাম তেলের দাম বাড়ার পর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সূর্যমুখী তেলের দামও বেড়ে যায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে শুধু ফুটপাতের খাবার দোকানগুলোতে বিপুল পরিমাণ তেলের প্রয়োজন পড়ে।
তেলের সরবরাহ কম থাকায় দক্ষিণ এশিয়ার তেল শোধনাগারগুলো ধীরে ধীরে বাজারে তেল ছাড়ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল আমদানিকারক ভারতেও তেলের দাম বেড়েছে। রেকর্ড দাম বাড়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে।
এ সংকট কত দিন থাকবে
পরিস্থিতি বিবেচনায় ধারণা করা হচ্ছে, তেলের এ সংকট ও উচ্চমূল্য ২০২২ সালজুড়ে ও ২০২৩ সালেও অব্যাহত থাকবে। বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৪ সালের আগে পাম ও সয়াবিন তেলের দাম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করতে হলে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে হবে। ইউক্রেনে যত তাড়াতাড়ি শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তত তাড়াতাড়ি এ সংকট দূর হবে। ইউক্রেনে কৃষি ও বাণিজ্যে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
এদিকে ২৩ মে ইন্দোনেশিয়া বিশ্ববাজারে পাম তেল ওপর থেকে রফতানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মূলত স্থানীয় কৃষকদের ক্ষোভের মুখে পড়ে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয় দেশটি। ইন্দোনেশিয়া সরকারের দাবি, ভোজ্যতেলের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় রফতানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হচ্ছে। তাদের এই পদক্ষেপ বিশ্ববাজারে তেলের দামে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।