বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল ২০২২
প্রথম পাতা » ছবি গ্যালারী | ঢাকা | শিরোনাম » চিকিৎসক-কোচিং সেন্টার চক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য
চিকিৎসক-কোচিং সেন্টার চক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য
স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর প্রেসের সাবেক মেশিনম্যান আব্দুস সালাম খানের সহায়তায় তাঁর খালাতো ভাই জসিম উদ্দিন ভুইয়া মুন্নু মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেন। ওই প্রশ্ন ও উত্তর বিক্রি করতে জসিম দেশব্যাপী গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটে যুক্ত হয় পাঁচটি কোচিং সেন্টার, ১২ জন চিকিৎসক, এনজিও কর্মকর্তা, ব্যাংকার, আবাসন ব্যবসায়ী, ছাত্রনেতাসহ অন্তত ৫০ জন। এঁদের ১৪ জনের ৯৯ কোটি ৮১ লাখ ৪৪ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।
সন্দেহভাজন আরো ১২ জনেরও কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে।
এ রকম অনেক তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও দীর্ঘ দুই বছরে কোনো মামলার অভিযোগপত্র দেয়নি অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্তে যাদের নাম এসেছে, সেসব ব্যক্তিকে রহস্যজনক কারণে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না।
মেডিক্যালের প্রশ্ন ফাঁসের চাঞ্চল্যকর মামলায় পাঁচ আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। চক্রের হোতা জসিম গ্রেপ্তারের পর তাঁর ডায়েরি থেকে সহযোগীদের নাম ও অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।
২০১৭ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ফাঁস তদন্তের সূত্রেই মেডিক্যালের প্রশ্ন ফাঁসের তথ্য পায় সিআইডি। ২০২০ সালের ২০ জুলাই মিরপুর থেকে চক্রের মূল হোতা জসিমসহ পাঁচজন এবং পরে সালামসহ আরো ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা হলেন জসিমের সহযোগী সানোয়ার, স্ত্রী শারমিন আরা জেসমিন শিল্পী, বোন শাহজাহী আক্তার মীরা, বোনজামাই আলমগীর হোসেন, জাকির হোসেন দিপু, ভাতিজা পারভেজ খান, ভাগ্নে মুবিন, সালামের ছেলে ইমন এবং খুলনা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী রেদওয়ানুর রহমান শোভন। এঁদের মধ্যে দীপু, পারভেজ, শোভন, ইমন ও সানোয়ার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ফাঁস ধরা পড়লে সিআইডি ৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে ৪৬ জনই আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। ১২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে ও পরে কর্তৃপক্ষ ৮৭ শিক্ষার্থীকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে। তবে মেডিক্যালে একই ধরনের জালিয়াতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলেও ব্যবস্থা গ্রহণে নেই কোনো তত্পরতা। তদন্তের স্থবিরতায় ‘ম্যানেজ বাণিজ্য’ চলছে বলে প্রশ্ন উঠেছে। গত তিন মাস ধরে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে মামলার অগ্রগতির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) কাজী আবু সাইদ মামলাটির বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি দুই দফায় দীর্ঘ সময় পেশাগত প্রশিক্ষণে রয়েছেন। মধ্যবর্তী সময়ে এএসপি নাসরিন সুলতানা মামলাটির তদন্তভার পান। জানতে চাইলে তাঁরা দুজনই কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তদন্তের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। ’
জানতে চাইলে সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) আশরাফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মামলায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু আসামি আছে, যারা পালিয়ে আছে। তাদের গ্রেপ্তার করে আমরা চার্জশিট দেব। ’
যাঁদের নাম এসেছে
জবানবন্দি ও নথিপত্র থেকে জানা যায়, ২০০৬ সাল থেকে সালামের সহায়তায় মেডিক্যালে ভর্তির প্রশ্ন ছাপাখানা থেকে ফাঁস করে পাঁচটি কোচিং সেন্টারসহ দেশব্যাপী বিক্রি করা হয়েছে। কোচিং সেন্টারগুলো হলো ঢাকার প্রাইমেট, ফেইম, ঢাকা-খুলনার থ্রি ডক্টরস এবং টাঙ্গাইলের এভিস ও ওমেগা। ওমেগা কোচিং সেন্টারের ডা. ইমরুল কায়েস হিমেল, ডা. সোলায়মান হোসেন মেহেদী, হিমেলের বাবা (শিক্ষক) কুদ্দুস সরকার, এভিস কোচিং সেন্টারের ডা. হাবিবুর রহমান হাবিব, উজ্জল সরকার ও নারায়ণগঞ্জের কাউসার আহমেদ এই কারবার করেন। ২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে দিনাজপুরে ডা. মেহেদীসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। অথচ তিনি এখন দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার সরকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। জানতে চাইলে ডা. মেহেদী বলেন, ‘আমি জড়িত নই। এটা হয়তো অন্য কেউ। ’
ঢাকার গ্রিন রোডের ফেইম কোচিং সেন্টারের মালিক ডা. ময়েজ উদ্দিন প্রধান একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সাবেক শিক্ষক। রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে তাঁর ছয়তলা বাড়িতে গেলে পরিবারের সদস্যরা কথা বলতে রাজি হননি।
আসামিদের জবানবন্দিতে বারবার এসেছে ঢাকার গ্রিন রোড ও খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের নাম। খুলনা শাখা থেকে শতভাগ শিক্ষার্থী মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পরই আলোচনায় আসে শাখার পরিচালক ইউনুসুজ্জামান খান তারিমের নাম। খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এই চিকিত্সক ‘অভিযোগের সত্যতা কেউ পায়নি’ বলে দাবি করেন। ঢাকায় কোচিং সেন্টারটির পাশের একটি অ্যাডমিশন সেন্টারের মালিক জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী জসিমের মাধ্যমে প্রশ্ন নিয়ে সেখানে দিত। ঢাকার থ্রি ডক্টরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঢাকা মেডিক্যালের চিকিত্সক ডা. বশিরুল হক বলেন, ‘আমি থ্রি ডক্টরসের সঙ্গে এখন যুক্ত নই। ’
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. জেডএমএ সালেহীন শোভন এবং নোয়াখালীর ডা. রুবেল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য। শোভন কিছুদিন পালিয়ে থেকে এলাকায় ফিরেছেন। জসিমের ডায়েরি ও যোগাযোগ থেকে ডা. সোহেল হায়দার, ডা. জিল্লুর হাসান রনি, ডা. হেলাল উদ্দিন ও ডা. ইব্রাহিম নামে আরো চার চিকিত্সকের নাম এসেছে। এ ছাড়া প্রাইমেট কোচিং সেন্টারের দিনাজপুরের রাশেদ ফারুক, সাভারের আবু রায়হান, যশোরের রওশন আলী হিমু, দিনাজপুরের এনজিওর মালিক শেখ আলমাস নয়ন, বিরামপুরের বিএম কলেজের শিক্ষক আল মাসুদ সাজ্জাদ, পঞ্চগড়ের কলেজ শিক্ষক সুজন, কোচিং ব্যবসায়ী আকতারুজ্জামান তুষার, ঠাকুরগাঁও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মোহাতার, টিঅ্যান্ডটির সাবেক কর্মকর্তা সাদেক, সৈয়দপুরের যুবলীগ নেতা মাহবুব, একটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তারেক, ব্র্যাক ব্যাংক কর্মকর্তা আতিকুল হাসান ওরফে লিটন, এস এম আহমেদুল হক ওরফে মনন, উত্তরার মুনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজের কর্মকর্তা লতিফ, সৈয়দপুরের মাহবুব, আইপ্যাডের কর্মী মঞ্জু, গাড়িচালক মাসুদ, কর্মচারী মমিন, নিতাই প্রকাশ, ভাড়াটে সহযোগী রউফ, সুজন, রাশেদ-২, সোহাগ, জামিল, কাইয়ুম ও শাহাদাতের নাম এসেছে।
রয়েছে কোটি টাকার সম্পদ, বৈধ উৎস নেই
প্রশ্ন ফাঁস চক্রের কোটি টাকার কারবারের তথ্য পেয়ে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ধানমণ্ডি থানায় মানি লন্ডারিং মামলা করে সিআইডি। প্রাথমিক তদন্তে জসিম, তাঁর স্ত্রী শিল্পী, খালাতো ভাই সালাম, বোন মীরা, ভগ্নিপতি আলমগীর, ভাজিতা পারভেজ ছাড়াও ডা. ময়েজ, তাঁর স্ত্রী সোহেলী জামান, সহযোগী রাশেদ খান, সাজ্জাদ হোসেন, ডা. শোভন, দিনাজপুরের আসলামের নাম আছে। তাঁদের মোট ৯৯ কোটি ৮১ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯৩ টাকার অবৈধ লেনদেনের তথ্য মিলেছে। থ্রি ডক্টরস খুলনার পরিচালক ডা. তারিমের ৩৫টি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ২৫ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়ে ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
সূত্র মতে, বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সংস্থা থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে সিআইডির আর্থিক অপরাধ তদন্ত শাখা।
জসিমের ৩৩টি ব্যাংক হিসাবে ২১ কোটি ২৭ লাখ টাকা জমা রাখার তথ্য মিলেছে। ৩২টি দলিলে এক হাজার ২২৬ শতাংশ জমি ও মিরপুরের শাহআলীতে ‘শাম্মী ভিলা’ ও ‘পৃথ্বি ভিলা’ নামে ছয়তলা দুটি বাড়ি আছে তাঁর। এ ছাড়া দারুস সালাম রোড, মুক্ত বাংলা মার্কেটে দেড় কোটি টাকার সাতটি দোকান ও তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর। তাঁর স্ত্রী শিল্পীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তিন কোটি ৭৮ লাখ ১৪ হাজার টাকার লেনদেনসহ অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদের হদিস মিলেছে।
প্রেসম্যান সালাম প্রশ্ন ফাঁস বাণিজ্য করে মানিকগঞ্জের সিংগাইরের ১০টিসহ ১১টি স্থানে সাড়ে তিন একর জমি কিনেছেন। তিন কোটি টাকার বেশি জমি ছাড়াও ব্যাংকে দুই কোটি টাকা আছে তাঁর।
ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধানের ৩৯টি ব্যাংক হিসাবে ১৯ কোটি ১৩ লাখ ৪১ হাজার ৫৮৯ টাকা লেনদেন এবং রাজাবাজার এলাকায় বাড়িসহ কয়েক কোটি টাকার সম্পদের তথ্য মিলেছে। তাঁর স্ত্রী সোহেলী জামানের ব্যাংক হিসাবেও মিলেছে তিন কোটি টাকার লেনদেন। থ্রি ডক্টরস একাডেমি নামে কোচিং সেন্টারে যুক্ত ডা. শোভনের পাঁচটি বাংক হিসাবে দেড় কোটি টাকার লেনদেনের প্রাথমিক তথ্য মিলেছে।
সিআইডির আর্থিক অপরাধ শাখার এস এস হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমাদের মামলার অনেক অগ্রগতি আছে। তদন্ত চলছে। ’