মাহে রমজানের মৌলিক দিকনির্দেশনা
আল কোরআনে ‘সিয়াম সাধনার ওপর দু’টি সুনির্দিষ্ট বিশেষত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : যেমন আল্লাহপাক তোমাদেরকে যে পথপ্রদর্শন করেছেন, তদানুযায়ী তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে পার এবং আল্লাহর শোকরগুজারী আদায় করতে পার। (সূরা হজ্জ : আয়াত-৩৭)। এই আয়াতে বিধৃত দু’টি মৌলিক দিকনির্দেশনা বিশ্লেষণ করার লক্ষ্যে আমাদেরকে অবশ্যই মাহে রমজানুল মুবারকের দিকে নজর দিতে হবে। কেননা, মাহে রমজানের মূল হাকীকাত অনুধাবন না করা পর্যন্ত উল্লিখিত দু’টি বিশেষত্ব আমরা পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারব না।
এই বস্তুময় জগত যেভাবে বস্তুভিত্তিক নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং আইনের আওতাভুক্ত, তেমনি আল্লাহপাক রূহানী জগতেরও এই শ্রেণির নিয়ম-শৃঙ্খলা বিধান এবং কার্যকারণ সম্পর্কিত বিষয়ের সিলসিলা কায়েম রেখেছেন। যে বিশ্বাসের সাথে আপনি এই দাবি করতে পারেন যে, ‘বিষ’ মানুষের ধ্বংসকারী, ঠিক সেই বিশ্বাসের সাথে আত্মিক রোগসমূহের চিকিৎসকও বলতে পারেন যে, গোনাহ হচ্ছে মানুষের রূহের হত্যাকারী। অর্থাৎ গোনাহ মানুষের রূহানী শক্তিকে হত্যা করতে সক্ষম।
নবী ও রাসূলগণ নবুওত মূলত ফয়েজ ও বরকতসমূহকে কবুল করার জন্য নিজেদের রূহে কিভাবে শক্তি উৎপাদন করেন; অস্বীকৃতি ও বিরুদ্ধবাদীতার প্রবাহকে কিভাবে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত করেন; কিভাবে আহ্বান অস্বীকারকারীরা বিফল ও ভগ্ন মনোরথ হয়; আর বিশ্বাসীগণ সকল এবং কামিয়াবরূপে গড়ে উঠেন; সুতরাং ওই সকল প্রতিটি বস্তুর বিকাশ সুনির্দিষ্ট ও সুনিয়ন্ত্রিত একক বিধান অনুযায়ীই পরিবধিত হতে থাকে। আল কোরআনের সর্বমোট তেরোটি স্থানে ‘সুন্নাতুল্লাহ’ (আল্লাহর পদ্ধতি) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এর প্রত্যেকটির মাঝেই বেশিরভাগ রূহানী শৃঙ্খলা বিধান ও নিয়মনীতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
ইতিহাসবিদগণ যেভাবে রাজনৈতিক ঘটনাবলির বার বার আগমন এবং বিভিন্ন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডকে বার বার পরীক্ষা নীরিক্ষার ভিত্তিতে শেষ পরিণাম পর্যন্ত উপনীত হয়ে সাধারণ ইতিহাসের নিয়মনীতি প্রবর্তন করেন, ঠিক তেমনি নবী রাসূলদের জীবন ইতিহাস এবং দিন তারিখ ও ঘটনাবলিকে বারবার উপস্থাপনের দ্বারা-নাবুওয়্যাতের বৈশিষ্ট্যাবলির নিয়মনীতিকে আমাদের জন্য বিন্যস্ত করা হয়েছে।
পয়গাম্বরসুলভ এসব ইতিহাস এবং নিয়মনীতির মাঝে একটি হচ্ছে এই যে, নবী তাঁর মানবতার পরিপূর্ণতা লাভ করে নবুওতের মঙ্গল ও বরকতকে কবুল করেন এবং যোগ্যতা লাভের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে এই যে, তখন তিনি একটি সময় পর্যন্ত মানবিক দুনিয়ার সমুদয় কর্মকাণ্ড থেকে পৃথক হয়ে ফিরিশতাসুলভ বৈশিষ্ট্যাবলির মাঝে সমাসীন হন।
সে সময় থেকেই তাঁর দিল ও দেমাগে আল্লাহ পাকের ওহীর প্রস্রবন-তরঙ্গের সৃষ্টি হতে থাকে। সিনাই পর্বতের মর্যাদাপূর্ণ নবী হযরত মূসা (আ.) যখন তাওরাত গ্রহণ করার জন্য গমন করলেন, তখন চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত রোজা পালন করেছিলেন। তাছাড়া সায়ী পর্বতে আগমনকারী পবিত্র সত্তা হযরত ঈসা (আ.) ইঞ্জিলের বাণী লাভ করার পূর্বে চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত পর্যন্ত সিয়াম পালন করেছিলেন।
অনুরূপভাবে পয়গাম্বর মোহাম্মাদ মোস্তাফা (সা.) কোরআন নাজিলের পূর্বে এক মাস পর্যন্ত হেরা নামক গিরি গুহায় সকল প্রকার ইবাদাত বন্দেগিতে নিমগ্ন ছিলেন। পরিশেষে সে অবস্থায় ‘নামুসে আকবার’ হযরত জিব্রাঈল (আ.) ‘পাঠকর তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’Ñ এই প্রাণস্পর্শী শুভ সংবাদ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ছিলেন। আল কোরআনে এ ঘটনাকে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছেÑ ‘রমজান মুবারক ওই মাস, যে মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে।’ এ ঘটনাটি ছিল কোনো এক পবিত্র রাতের ইতিহাস। একথাও আল কোরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন- ‘নিশ্চয়ই আমি এই কোরআনকে এক বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি।’
উল্লেখিত আয়াতসমূহের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রমজান সেই পবিত্রতম মাস, যে মাসে সর্ব প্রথম কোরআনুলকারীম দুনিয়ায় নাজিল হয়েছে। এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) সারা জগতের পথ নির্দেশনা এবং মানুষের উপকার ও হিত সাধনের লক্ষ্যে আল্লাহপাকের ওহী বহনকারী এবং ওহীয়ে ইলাহীর সংরক্ষণকারী হিসেবে একইভাবে হেরা গিরি গুহার অভ্যন্তরে ক্ষুৎপিপাসায় অত্যন্ত কাতর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন।
একই কারণে এই পবিত্র মাসে পানাহার থেকে বিরত (রোজা পালন করা) এবং কোনো ইবাদতগাহে অবস্থান করা (ইতিকাফ করা) এবং ওহী নাযিলের রাতে (শবে কদরে) বিনিদ্র রাত অতিবাহিত করা। শরীয়তে মোহাম্মাদীর (সা.) অনুসারীদের একান্ত কর্তব্য। তাই তো আল কোারআনে ঘোষণা করা হয়েছে : ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহপাক তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।’