রবিবার, ২৭ মার্চ ২০২২
প্রথম পাতা » আন্তর্জাতিক | কৃষি ও বাণিজ্য | ছবি গ্যালারী | শিরোনাম » রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: লাভের ভাগ পাচ্ছে ভারত
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: লাভের ভাগ পাচ্ছে ভারত
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে লাভের ভাগ যাচ্ছে ভারতের ঘরে। একদিকে সস্তায় জ্বালানি তেল ও গ্যাস কেনার সুযোগ, অন্যদিকে বৈশ্বিক রফতানি বাজারে আধিপত্যের জায়গা পেয়ে যুদ্ধটি ভারতের জন্য শাপে বর হয়েছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষার্ধে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপরে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিজ দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে এশীয় দেশগুলোর দ্বারস্থ হয় রাশিয়া। সেই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করছে ভারত।
মার্চের শুরুর দিকে রাশিয়া থেকে যখন একে একে সবকটি পশ্চিমা কোম্পানি নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই চীন ও ভারতকে নিজ দেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানায় রাশিয়া।
এ ছাড়া ভারত রাশিয়া থেকে সস্তায় কিনছে জ্বালানি তেল। ধারণা করা হচ্ছে রাশিয়া থেকে ভারত ১৫ মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেল কিনবে। বিশেষ ছাড়ে প্রতি ব্যারেলে ভারত ২২ দশমিক ৭ ইউরো পর্যন্ত লাভ করতে পারবে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে ইন্ডিয়ান ওয়েল করপোরেশন রাশিয়া থেকে ৩ বিলিয়ন জ্বালানি তেল ক্রয় করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী মে মাসের মধ্যে ভারতের কাছে ক্রয়কৃত তেল সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
যদিও রাশিয়ার দেওয়া বিশেষ ছাড়ের এই প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু ভারত তা আমলে নেয়নি। চলতি মাসের ১৫ তারিখে হোয়াইট হাউসের প্রেসসচিব জেন সাকি নয়াদিল্লিকে রাশিয়া থেকে কম দামে অপরিশোধিত তেল কেনার পরিকল্পনা না করার অনুরোধ করেছেন। কেননা ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনলে দেশটির ওপরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব অনেকখানিই ঝিমিয়ে পড়বে। এতে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে রাশিয়া আরও উৎসাহ পাবে বলে মন্তব্য করেন সাকি।
কেবল জ্বালানি তেল নয়, শস্য রফতানিতেও যুদ্ধের সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে ভারত। মূলত পশ্চিমা দেশগুলো গম ও ভুট্টা আমদানিতে অনেকটাই রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ইউক্রেনে যুদ্ধ ও রাশিয়ার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ফলে গম আমদানি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে ইউরোপের ত্রাণকর্তা হিসেবে ভারত তাদের জায়গাটি পাকাপোক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বৈশ্বিক গমের চাহিদার ২৫ শতাংশ সরবরাহ হতো রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। বর্তমানে এই দুটি দেশ থেকে ইউরোপে গম আমদানি এক রকমের বন্ধ থাকায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলো খাদ্যসংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেবল গম নয় বৈশ্বিক ভুট্টা আমদানির ১৩ শতাংশই ছিল ইউক্রেনের দখলে। সেখানেও সৃষ্টি হয়েছে বড় রকমের ঘাটতি।
এমতাবস্থায় খাদ্য সংস্থা এপিইডিএর তথ্যানুসারে, বৈশ্বিক বাজারে ভারত তাদের আমদানি বৃদ্ধি করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে ভারত গম, ভুট্টা, বাদাম, ডালসহ বিভিন্ন রকমের শুকনা খাদ্যপণ্য আমদানি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ববাজারে ভারতীয় খাদ্যপণ্যের চাহিদা কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে তা মুম্বাইয়ের কুনাল করপোরেশনের মুখপাত্র কুনাল সাহের দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে সহজেই অনুমেয়। তিনি বলেন, ‘আগে আমরা প্রতি বছর ৫০-৬০ কনটেইনার গম আমদানি করতাম। এবার বছরেই শুরুতেই ৪০ কনটেইনার গমের অর্ডার পেয়েছি। কেবল গম নয় দিনকে দিন আমাদের ভুট্টার চাহিদাও বাড়ছে।’
ওলাম এগ্রো ফার্মের কর্মকর্তা নিতেন গুপ্তা বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে বিশ্বের অন্য কোনো দেশ থেকে নতুন গম আমদানি করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে একমাত্র ভরসাস্থল ভারত। এতে চাইলেই গমের দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফা লাভ করা সম্ভব।’
গম আমদানিতে ভারতকে টক্কর দেওয়ার মতো আপতত যে দেশটির নাম সামনে আসছে সেটি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া থেকে নতুন গম পাওয়া সম্ভব নয়। অস্ট্রেলিয়া থেকে গম কিনতে হলে পশ্চিমা দেশগুলোকে পরবর্তী গমের মৌসুম অর্থাৎ নভেম্বর মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আগামী আট মাসের মধ্যে ভারত বিশ্ববাজারে ১০-১২ মিলিয়ন টন গম আমদানি করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন নিতেন গুপ্তা।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ইউক্রেন তাদের খাদ্য আমদানি বন্ধ করে দেয়। মূলত নিজ দেশকে দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচাতে খাদ্য মজুত রাখছে ইউক্রেন। এতে করে দেশটি থেকে গম, যব, ভুট্টা, চিনি, গবাদিপশুর খাবার ও দুগ্ধপণ্যের আমদানি একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে ভারত সহজেই ইউক্রেনের এসব পণ্যের ওপরে নির্ভরশীল মিসর, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, নাইজেরিয়া, ইতালি ও বাংলাদেশের বাজারে নিজেদের স্থান তৈরি করে নিতে পারবে।
এ ব্যাপারে এপিইডিএর চেয়ারম্যান এম অঙ্গামুথু বলেন, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়াতে ভারতের গম এমনিতেই প্রসিদ্ধ। এখানে নিজেদের বাজার অব্যাহত রাখতে চাইবে দেশটি। অন্যদিকে নয়াদিল্লি তুরস্ক, মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের গম আমদানি প্রসারিত করতে চাচ্ছে। বহুকাল ধরে এসব দেশে গম আমদানিতে রাজত্ব করে আসছিল রাশিয়া ও ইউক্রেন।
এ ব্যাপারে অঙ্গামুথু বলেন, ‘আমাদের স্বল্পমেয়াদি লাভের কথা চিন্তা করে নতুন বাজার সৃষ্টির থেকে পুরনো বাজারেই নিজেদের আধিপত্য আরও শক্তিশালী করা উচিত।’ ভারত মূলত দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকা এই তিনটি ভৌগোলিক এলাকাকে কেন্দ্র করে নিজেদের আমদানি বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে বেহিসাবি আমদানি বাণিজ্য চালিয়ে যেতে থাকলে দেশীয় বাজারে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ভারতীয় অর্থনীতিবিদরা। ভারতে প্রতি বছর ১০০ মিলিয়ন টনের বেশি গম আমদানি হলেও দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারে গমের চাহিদা ব্যাপক। এতে করে চাইলেও দেশটি বেহিসাবি গম আমদানি করতে পারবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে বাজার ধরতে ভুট্টার উৎপাদন বাড়িয়েছে ভারত। জাস্ট অরগানিকের মুখপাত্র পঙ্কজ আগারওয়াল বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ভুট্টার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈশ্বিক বাজারে লাভবান হতে ইতোমধ্যে ভুট্টা আমদানিতে মনোযোগী হচ্ছেন তারা। এরই অংশ হিসেবে চলতি অর্থবছরে কোম্পানিটি ২৫০ টন ভুট্টা উৎপাদনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে উত্তরখণ্ডে ৪ হাজার কৃষক নিয়োগ দিয়েছে। মূলত জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক ও ইতালিতে আমদানির উদ্দেশ্যে ভুট্টা উৎপাদন করা হচ্ছে বলে জানায় পঙ্কজ।
কতদিন যুদ্ধ থেকে এই সুবিধা আদায় করতে পারবে ভারত- এমন প্রশ্নের জবাবে নিতেন গুপ্তা বলেন, ‘এখনই নিশ্চিত হয়ে বলা মুশকিল। হতে পারে এটা কয়েক মাস কিংবা কয়েক বছর। তবে যুদ্ধ শেষ হলেও ইউক্রেনের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে। অন্যদিকে রাশিয়ার ওপরে নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘ সময় ধরে বহাল থাকবে বলে আশা করা যায়।’
তবে এত সুখের মাঝেও ভারতের সামনে রয়েছে দুটি বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। প্রথমত বিশ্ববাজারে কনটেইনার সংকটের ফলে বাণিজ্য দিনকে দিন ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে দূরদেশে বেশি লাভের আশায় ঝুঁকি না নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে নিজেদের পণ্য আমদানি বাড়ানোর দিকে জোর দিতে বলছে দেশটির অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্ট করপোরেশনগুলো।
অন্যদিকে বাইরে লাভ করতে গিয়ে যাতে নিজের দেশে খাদ্যঘাটতি ও মূল্যস্ফীতি দেখা না দেয় সেদিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে ভারতকে। করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশটিতে বড় রকমের মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতকে নিজ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্ববাজারে ব্যবসা বিস্তৃত করার পরামর্শ দিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র- ইকোনমিক টাইমস, রয়টার্স, বিবিসি