রবিবার, ৬ মার্চ ২০২২
প্রথম পাতা » ছবি গ্যালারী | ঢাকা | শিরোনাম » কৃত্রিম জ্যাম তৈরি করে ডাচ-বাংলার বুথ থেকে ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ
কৃত্রিম জ্যাম তৈরি করে ডাচ-বাংলার বুথ থেকে ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ
ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বুথে টাকা লোড-আনলোডসহ মেইনটেন্যান্সের দায়িত্ব পালন করছে গার্ডা শিল্ড। আব্দুর রহমান নামে একজন সেখানে চাকরি নেওয়ার পর প্রতারণা শুরু করেন। তার নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল আর্থিক প্রতারণায় অংশ নেন। প্রতিদিন বিভিন্ন এটিএম বুথে কৃত্রিম জ্যাম সৃষ্টির মাধ্যমে ৬০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিতেন তারা। গত এক বছরে প্রায় তিন কোটি টাকা একই কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে আব্দুর রহমানের নেতৃত্বাধীন চক্রটি।
সাময়িকভাবে ব্যাংকের গ্রাহক বুথ থেকে টাকা উত্তোলনে ব্যর্থ হয়ে ভোগান্তির শিকার হলেও অভিযোগের প্রেক্ষিতে বুথে আটকে যাওয়া টাকা ফেরত পেতেন। তবে ক্ষতির সম্মুখীন হতো ডাচ-বাংলা ব্যাংক। অভিযোগ উঠত সিকিউরিটি এজেন্সির বিরুদ্ধে। ব্যাংকের অডিটে উঠে আসে আর্থিক ছয়-নয়ের হিসাব।
মামলার প্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করে র্যাব। র্যাবের তদন্তে ও সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণের পর চক্রটির মূলহোতা আব্দুর রহমানসহ আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। অভিনব কৌশলে জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকটির দুই শতাধিক এটিএম বুথ মেশিন থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের ওই আট সদস্যকে শনিবার (৫ মার্চ) দিবাগত রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
রোববার (৬ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, একটি স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক ব্যাংক ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম এটিএম বুথের ব্যবহার শুরু করে। পরে প্রায় সব ব্যাংকে এর প্রচলন ঘটে। কিন্তু এটিএম বুথ ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে বেশকিছু অভিযোগ আলোচনায় আসে। বিগত সময়ে র্যাব এটিএম বুথে ডাকাতি, হত্যা ও অবৈধভাবে কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের ঘটনায় দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যাংক এটিএম বুথের ব্যবস্থাপনা থার্ড পার্টি বা আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করে থাকে। থার্ড পার্টি টাকা স্থাপন, নিরাপত্তা, কারিগরি ত্রুটিসহ নানা বিষয় পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের অডিটে এটিএম বুথের টাকার বেশকিছু গড়মিল দেখা যায়। ফলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ থার্ড পার্টি আগের একটি সিকিউরিটি এজেন্সির (জি-৪ সিকিউরিটি গার্ড এজেন্সি) সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে। নতুন করে গার্ডা শিল্ডের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করে। কিন্তু অনিয়ম ও অর্থের গড়মিল বন্ধ হয়নি। ব্যাংক অডিটে বিষয়টি আসার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও থার্ড পার্টি সিকিউরিটি এজেন্সি গার্ডা শিল্ড র্যাবের শরণাপন্ন হয়।
র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও ছায়া তদন্ত শুরু করে। ছায়া তদন্তের একপর্যায়ে র্যাব উদঘাটন করে থার্ড পার্টি পরিবর্তিত হলেও টাকা লোডার ও অন্যান্য কারিগরি দলে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে র্যাব তদন্ত অব্যাহত রাখে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৪ এর একটি দল রাজধানীর মিরপুর, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী ও বাড্ডা এলাকায় অভিযান চালিয়ে আব্দুর রহমান বিশ্বাস (৩২), তারেক আজিজ (২৫), তাহমিদ উদ্দিন পাঠান ওরফে সোহান (২৮), রবিউল হাসান (২৭), হাবিবুর রহমান ওরফে ইলিয়াস (৩৬), কামরুল হাসান (৪৩), সুজন মিয়া (৩১) এবং আব্দুল কাদের (৪৩) কে গ্রেপ্তার করে।
অভিযানে উদ্ধার করা হয় দুটি চেকবই, একটি এটিএম কার্ড, চারটি আইডিকার্ড, একটি স্বর্ণের নেকলেস, এক জোড়া বালা, এক জোড়া কানের দুল, একটি আংটি এবং নগদ ৯ লাখ ৪১ হাজার ৫৫৫ টাকা।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা পরস্পর যোগসাজশে বেশ কয়েকটি এটিএম বুথ থেকে টাকা আত্মসাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে র্যাবের কাছে তথ্য দেয়।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তাররা একটি সংঘবদ্ধ চক্র। তারা গত ২/৩ বছর এক সঙ্গে চাকরি করার সুবাদে পরিচিত হন। একপর্যায়ে তারা সমমনাদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে। গ্রেপ্তার আব্দুর রহমান চক্রটির মূলহোতা। তিনি তার এক সাবেক সহকর্মীর কাছ থেকে বিষয়টি রপ্ত করেন বলে জানান।
গ্রেপ্তার অন্য সহযোগীরা কন্ট্রোল রুম, লোডিং, কলিং এবং মেইনটেনেন্সের দায়িত্ব পালন করে থাকে। গ্রেপ্তাররা ব্যাংকের এটিএম বুথে টাকা স্থাপন ও মনিটরিং কাজে নিযুক্ত ছিল। তারা ঢাকা শহরের ২৩১টি এটিএম বুথ মেশিনে টাকা লোড করে থাকে। এই ২৩১টি এটিএম বুথ মেশিনে টাকা স্থাপনের জন্য ১৯ জন লোডার নিযুক্ত রয়েছে; যারা প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে অর্থ পৌঁছে দেয়। এছাড়া টেকনিক্যাল এক্সপার্ট, কারিগরি সংক্রান্ত বিষয়ে বেশ কয়েকজন নিয়োজিত থাকত।
প্রতারণার কৌশল
গ্রেপ্তাররা লোডিং ট্রে-তে টাকা স্থাপনের সময় ১৯টি ১০০০ টাকার নোটের পরপর অথবা অন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ইচ্ছাকৃতভাবে জ্যাম করে রাখতো। কোনো ক্লায়েন্ট এটিএম বুথে টাকা উত্তোলনের জন্য এটিএম কার্ড প্রবেশ করিয়ে গোপন পিন নম্বর দিয়ে কমান্ড করলে ওই পরিমাণ টাকা ডেলিভারি না হয়ে পার্সবিনে জমা হতো। পরে সেই টাকা সরিয়ে নিতো চক্রের সদস্যরা। এক্ষেত্রে মেশিনের একটি কৌশল অবলম্বন করে তারা টাকাগুলো আত্মসাৎ করত।
গ্রেপ্তার আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি এই চক্রের মূলহোতা। তিনি ৩/৪ বছর আগে জি-৪ সিকিউরিটিতে চাকরি করতেন। আর্থিক অনিয়ম ও টাকা উধাওয়ের কারণে জি-৪ সিকিউরিটি এজেন্সির সঙ্গে ডাচ বাংলার চুক্তি বাতিল হলে গ্রেপ্তার চক্রের মূলহোতা আব্দুর রহমান পুরো চক্রটি নিয়ে নতুন চুক্তিবদ্ধ গার্ডা শিল্ড সিকিউরিটিজ এজেন্সিতে চাকরি নেয়। তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকা মিরপুর, কালশী, বেনারশি, সেনপাড়া, ইব্রাহিমপুর ও কচুক্ষেত এলাকা। তিনি প্রতিদিন বিভিন্ন এটিএম বুথে কৃত্রিম জ্যাম সৃষ্টির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করে আসছিলেন।
চক্রের সব সদস্যই শিক্ষিত
এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, চক্রটির সবাই শিক্ষিত। তবে বেতন পেতো ১৪ থেকে ২০ হাজার টাকা। কিন্তু তারা আত্মসাৎ করা টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করতেন।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, গ্রেপ্তার আব্দুর রহমান, সোহাগ পাঠান, হাবিব ও কামরুল এটিএম বুথে লোডিং, কলিং ও মেইনটেনেন্সের কাজ করেন। গ্রেপ্তার কাদের, সুজন, রবিউল ও তারেক আজিজ এটিএম বুথে শুধু লোডিংয়ের কাজ করেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এক বছরে তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ
চক্রটি প্রতিদিন ৬০ থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত কৃত্রিম জ্যাম তৈরির পর আটকে রেখে আত্মসাৎ করত। এভাবে ৯ মাসে প্রায় ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে দাবি করেছে।
কারও সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও দায় ছিল সিকিউরিটি এজেন্সি-ব্যাংকের
কমান্ডার মঈন বলেন, থার্ড পার্টি হিসেবে গার্ডা শিল্ডের দায় ছিল। কারণ তারা লোকবল নিয়োগে অতীতের তথ্য ঘাটেনি। শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছে। আর সংশ্লিষ্ট ব্যাংক টাকা লোড-আনলোডের ক্ষেত্রে নজরদারি রাখেনি। ব্যাংকের ও সিকিউরিটি এজেন্সির কারও সংশ্লিষ্টতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চক্রে জড়িত পলাতক অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।